বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গভনিং বোর্ডের সভায় মিরসরাইয়ে একটি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মিরেসরাইয়ে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
ওই প্রকল্পের নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুনের কারনে বেজার সামগ্রিক অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন শুরু নিয়ে শংকায় আছেন উদ্যোক্তারা। তারা মনে করছেন বেজার হয়রানি বন্ধ না হলে অনেকেই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়বেন। ট্যাক্স হলিডে থাকলেও উৎপাদনে নেওয়া হচ্ছে ১৫ শতাংশ। মালামাল লোড-আনলোডের জেটি হয়নি। নিজ উদ্যোগে করতে গেলেও জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বেজার চেয়ারম্যানের দফতরে ফাইল গেলে সেই ফাইলের আর কোন গতি থাকেনা।
উদ্বোধনের পর থেকে ৬ বছর পার হয়ে গেলেও এই অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। চলতি বছরের মধ্যেই কিছু কারখানা উৎপাদনের পর্যায়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকলেও সংকট হিসেবে সামনে এসেছে বিদ্যুৎ সরবারহ।
কারখানগুলোর সংবেদনশীল যন্ত্রপাতির জন্য মানসম্মত, নিরবিচ্ছিন্ন ও কম ভোল্টেজ ফ্ল্যাকচুয়েশন বিদ্যুৎ প্রয়োজন। যা ২৩০ কেভি লাইনের মাধ্যমেই সম্ভব। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। ২৩০ কেভি ভোল্টেজ সরবরাহের সক্ষমতা তাদের নেই।
এই শিল্পনগরীতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাওয়ার জন্য শতভাগ প্রস্তুত। বিদ্যুতের কারণে তাদের উৎপাদনও পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২৩০ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে বিদ্যুৎ সরবরাহে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) অবকাঠামো ও পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও আইনি জটিলতায় সেটা করতে পারছেনা সংস্থাটি। এই আইনি জটিলতা নিরসনের জন্য পিডিবি থেকে ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে মতামত চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পরও ওই সমস্যা সমাধান হয়নি।
এসব সমস্যা সমাধানের জন্য যাদের দায়িত্ব তারা এখনো সরব নন। উদ্বোধনের সময় ঘনিয়ে আসলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেজা- বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ শিল্পনগরটিতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি।
এছাড়া অঞ্চলটিতে বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স হলিডে পাওয়ার কথা থাকলেও উৎপাদনে যাওয়ার আগেই ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওয়ান স্টপ সার্ভিসতো (ওএসএস) নেই রবং সব ক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে স্থবিরতা ও নিষ্ক্রিয়তা।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বিএসআরএম গ্রুপ অব কোম্পানিজ, ম্যাঙ্গু টেলিসার্ভিসেস, স্টার অ্যালাইড বেঞ্চার, অনন্ত গ্রুপ, হেলথ কেয়ার ফার্মাসিটিক্যালস, বাংলাদেশ এডিবয়েল অয়েল, উর্মি গ্রুপ, মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডাইং মিলস, বিডিকম অনলাইন, রাতুল অ্যাপারাইলস, যমুনা স্পেসটেক জয়েন্ট বেঞ্চার, ইউরোএশিয়া ফুড প্রসেসিং, হামকো কর্পোরেশন, এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশন, উত্তরা মটরস, ডিবিএল গ্রুপ, ওয়েল গ্রুপ, রেজা পেশন, ইন্টিগ্রো অ্যাপারাইলস, লামিল অ্যাপারাইলসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লক্ষাধিক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
বড় বিনিয়োগের এসব শিল্প কারখানা নির্মানের পরেও যথা সময়ে চালু করা সম্ভব না হলে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়বে। উদ্যোক্তরা বলেন, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণে নিয়ে শিল্প কারখানা তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত মেশিনারিজ ক্রয় আদেশ ও সংস্থাপন করা হচ্ছে। উৎপাদন যথাসময়ে শুরু না হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের দায় প্রদান করতে না পারলে খেলাপি হবে উদ্যোক্তরা।
এখানেই শেষ নয়। শুরু হয়নি বিদ্যুৎ সরবরাহের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানি-গ্যাসেরও ব্যবস্থা হয়নি।
কারখানের উৎপাদনের জন্য কাঁচামালের পাশাপাশি পানি ও গ্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। ২০২০ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের উপসচিব মো. আ. আলীম খান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারখানা অবকাঠামো নির্মাণ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে নির্ধারিত শর্ত পালনপূর্বক প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও গ্যাস চাহিদা মোতাবেক সময়ের মধ্যে সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়। পরবর্তীতে ওই বছরের ৪ অক্টোবর অপর এক চিঠিতে প্রথম পর্যায়ে মুহুরী রিজার্ভার হতে ৫০ এমএলডি ওয়ার্টার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি ও পরবর্তীতে আরো ৫০ এমএলডিসহ ১০০ এমএলডি পানি সরবরাহের কথা বলা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রথম পর্যায়ের অর্থাৎ ৫০ এমএলডির কাজ শেষ হবে। কিন্তু ২০২২ সালের অক্টোবরেও প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়নি। পাশাপাশি পানির বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য ডি-স্যালাইনেশন প্ল্যান্ট স্থাপন করার কথা জানানো হলেও এখনও কোন কাজ শুরু হয়নি। ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির উদ্যেক্তাদের জন্য পানি সরবরাহের কোন ব্যবস্থায় করা হয়নি।
ব্যাক্তি উদ্যোগে পানির জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গভীর নলকূপ বসানো হলেও তার মধ্যে মিটার লাগিয়ে ওয়াসার হারে বিল নিচ্ছে বেজা। সেই সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আদায় করা হচ্ছে।
এদিকে, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত উৎপাদন শুরু প্রচেষ্ঠা করলেও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপদানে যেতে পারছে না। তাই, প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব অর্থায়নেই গ্যাস সরবরাহ লাইন স্থাপনের চেষ্টা করছে। কিন্তু বেজার গড়িমসির কারণে তাও সম্ভব হচ্ছে না। প্লট বরাদ্দে ভ্যাট অব্যাহতির কথা থাকলেও নেওয়া হচ্ছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে গঠনের সময় প্লট বা জমি ইজারার সময় ভ্যাট প্রদানের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এখন ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। যা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। চলতি বছরের ১৫ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহাররর চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বেজা কর্তৃক বরাদ্দকৃত জমি ইজারা প্রদানের ভ্যাট প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সিন্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন শিল্প উদ্যোক্তরা।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান ব্যক্তিকেন্দ্রীক প্রশাসন পরিচালনা করছেন। ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইকনোমিক জোনের কার্যক্রম শুরুর পর বেজার তৎকালীন নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী একাধিকবার প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। তিনি বিভিন্ন সময় উদ্যোক্তাদের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা খুঁজে বের করে সমাধানও করেন।
কিন্তু বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন দায়িত্বে আসার পর তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রীক প্রশাসন পরিচালনা করছেন। ফলে, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। পরিচালন ব্যবস্থায় একনায়কতন্ত্র আসায় বর্তমানে প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে অনেক সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান না করলে এই শিল্প অঞ্চলটি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে অক্ষম হবে বলে অভিজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//অক্টোবর ২২,২০২২//

Discussion about this post