আমি মনে করি বঙ্গবন্ধু হত্যার যে বিচার হয়েছে তা অসমাপ্ত ও আংশিক। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত কয়েকজনের বিচার হয়েছে মাত্র। কিন্তু নেপথ্যের পরিকল্পনায় যারা ছিলো তাদের বিচার হয়নি। রাজনৈতিক পরিকল্পনাকারিদের বিচার হয় নি। একটি কমিশন গঠন করে এই পরিকল্পনাকারিদের বিচার করা উচিত। কারা এই পরিকল্পনায় ছিলো তা বের হওয়া দরকার।
আমার সাংবাদিকতা জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম কাছ থেকে দেখা। হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্টে দিনের পর দিন হাজির থেকে যুক্তিতর্ক শুনেছি। কৌতুহল থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ পড়ে, জেনে আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই,বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার হয় নি। নেপথ্যের কুশীলবরা আড়ালেই রয়ে গেছে।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট তাই বলে। আমি মনে করি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অতন্দ্র প্রহরী সেনাবাহিনী। তাদের দায়িত্ব দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। রাষ্ট্রপ্রধানকে রক্ষা করা। তাদের শপথও তাই। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট একজন সেনা কর্মকর্তা সেই দায়িত্ব ও শপথ পালন করেননি।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, ওই সময়ে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধানকে বিপথগামী একদল সেনা কর্মকর্তা এসে বলেছিলেন “আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তন করতে চাই”। উনি বলেছিলেন ‘এ সবে আমাকে জড়াবে না। তোমরা জুনিয়ররা যা ভালো মনে হয় করো।’
এর মাধ্যমে তিনি শপথ ভঙ্গ করে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছিলেন। কারন প্রচলিত আইনের যুক্তি বলে, কোন ব্যক্তি যদি কাউকে খুন করার কথা বলে এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ যদি খুনের পরিকল্পনাকারিকে আইনের হাতে তুলে দেয় তবে সেটা হবে অপরাধ। আর সেনা আইনে এমন অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ড। তা না করলে তিনি হবেন হত্যাকান্ডের পরিকল্পক।
ইতিহাস ঘেটে যা জানলাম তাতে দেখা যায়,বঙ্গবন্ধুর খুনী ফারুক, রশীদ উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, তারা রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন করতে চান। জেনারেল জিয়া বলেছেন তিনি নিজে এতে জড়াবেন না, জুনিয়ররা কিছু করতে চাইলে তারা নিজ দায়িত্বে করবে।
খুনীচক্র এর মাধ্যমে জেনারেল জিয়ার গ্রীণ সিগন্যাল পেয়ে যায়। ফলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনাকারি হিসেবে জেনারেল জিয়াকে বাদ দিবেন কেমনে? আমিতো মনে করি বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারিই জেনারেল জিয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় জেনারেল জিয়াকে কেনো আসামী করা হলো না এটাই আমার প্রশ্ন। মরণোত্তর বিচার হলেওতো ইতিহাসের সত্য উদঘাটিত হতো। রেকর্ড থাকতো।
প্রসঙ্গত পাকিস্তানের রিসালপুর মিলিটারি একাডেমিতে ফারুক, রশিদ যখন প্রশিক্ষণ নেন তখন প্রশিক্ষক ছিলেন জিয়া। সেই থেকে তাদের ছিলো গভীর সম্পর্ক।
মুজিব হত্যার পরিকল্পনায় জিয়া সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং তিনি সবকিছু জানতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জিয়ার আরও আচরণে। ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল ভোর বেলা জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে খুলেন। জিয়ার গায়ে স্লিপিং ড্রেসের পায়জামা এবং সান্ডো গেঞ্জি। ভোর বেলাই তিনি শেভ করছেন একগালে শেভিং ক্রিম লাগানো। শাফায়াত জামিল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইজ কিল্ড। কিন্তু এতে জিয়াকে মোটেও বিচলিত মনে হয় নি। তিনি শান্তকণ্ঠে বলেন,’প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইওর ট্রুপস রেডি। আপহোল্ড দি কন্সটিটিউশন।’
দৃশ্যটা ভাবুন, দেশের প্রসিডেন্ট মারা গেলেন আর উপ- সেনাপ্রধান নির্বিকার ভাবে বললেন, ‘সো হোয়াট? ‘ তার মানে এমন ঘটনা ঘটবে তিনি জানতেনই।
ভীরু ও কাপুরুষ সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে দায়িত্ব অবহেলার জন্য বিচার করা উচিত ছিলো। কারণ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমন হলে, জেনারেল শফিউল্লাহকে বঙ্গবন্ধু ফোন করলে, শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। হাইকোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তৃতীয় বিচারপতি ফজলুল করিম এই ভীরু অপদার্থ সেনাপ্রধানকে কেনো আসামী করা হয় নি সে প্রশ্ন রেখেছিলেন। যাক সে প্রসঙ্গ,বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরে পড়ে আছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সেদিন সকালে চীফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ ও উপ- সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সেনাসদরে ডাকেন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ । খালেদ মোশাররফ তার ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে রাতের পোশাকেই দ্রুত চলে আসেন। তার কিছুক্ষণ পরে আসেন জিয়াউর রহমান তার ড্রাইভার চালিত অফিসিয়াল গাড়িতে, ক্লিন শেভড এবং মেজর জেনারেলের পূর্ণাঙ্গ ইউনিফর্মে। এতেই বুঝা যায় জিয়া সবকিছু জানতেন। সব প্রস্তুতি নিয়েই তিনি আসেন। সেই হিসেবে তার কোন বিচার হয়নি।
–লেখক: শংকর মৈত্র, আইন আদালত বিটের সিনিয়র সাংবাদিক।