Print Date & Time : 11 May 2025 Sunday 4:19 am

বন্যার দ্বিতীয় দফায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সুনামগঞ্জ

ভারি বৃষ্টিপাত এবং ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে সুরমা নদীসহ সকল নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিতীয় দফা বন্যা হয়েছে। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের মানুষ।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানিতে শতভাগ প্লাবিত হয়েছিল পৌর সদরসহ জেলার ৬টি উপজেলা। ১৫ জুন বুধবার সকাল থেকে সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ পৌরশহরের ষোলঘর পয়েন্টে দিয়ে বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে ২০ জুন সোমবার পর্যন্ত বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত অতিক্রম করে।

৬ দিনের একটানা বন্যায় মানুষ,গবাদিপশু,হাঁসমুরগী,খাদ্যশষ্য,গোখাদ্য,পরনের কাপড় চোপড়,বইপত্র সিলিন্ডারসহ গ্যাসের চুলা,লাকড়িসহ জ্বালানী ও কাচা আধাপাকা বসতবাড়ী  সবকিছুই বানের জলে ভেসে যায়।

১৯৭৪,১৯৮৮ ও ২০০৪ সালে বড় ধরনের বন্যা হয় সুনামগঞ্জে। কিন্তু এবারের বন্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তবে প্রশাসন যদি পূর্ব থেকে বন্যার সতর্কবার্তা জানিয়ে মাইকিং করতো তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যেত।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছিল, ভারতের মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টির কারনে সুনামগঞ্জের সুরমাসহ সবকটি শাখা নদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অবস্থার যে এত অবনতি হবে তা তারা ভাবতে পারেনি।

জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়,পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ সদর, দিরাই ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।

পাহাড়ি ঢলের কারণে দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সম্প্রতি জেলায় আড়াইশরও বেশি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকায় তড়িঘড়ি করে ধান কেটে নিয়েছিলেন যেসব কৃষক, তারাও হয়েছিলেন নতুন বিপদের সম্মুখীন। অনেকের গোলার ধান পানিতে ভেসে গেছে।

জেলা প্রশাসক, জেলা ও দায়রা জজ, জেলা পুলিশ সুপারের বাসভবন, বিদ্যুৎ অফিস, গ্যাস অফিসসহ শহরের সকল সরকারী বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো জলমগ্ন ছিল। টানা ৬দিন সারা দেশের সাথে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ছিল।

সুনামগঞ্জ শহরতলীর ইব্রাহিমপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ এমরান হোসেন বলেন, আমরা বারবার বলছি পাহাড়, সমতল ও হাওড় এই তিনে মিলে সুনামগঞ্জ। পাউবো যদি বাঁধ করতেই হয় তাহলে তারা যেন জেলার হাওর অংশে বাঁধ করে। সুনামগঞ্জ সদর থানার সুরমা, জাহাঙ্গীরনগর ও রঙ্গারচর এবং বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের ধোপাজান চলতি নদীর পাড়ে বাঁধের কোন প্রয়োজন নেই বা ছিলনা। কারণ এই এলাকায় যেমন বোরো ফসলের আবাদ খুব কম তেমনি নদীর দুই পারে বাঁধের কাজ করলে পাহাড়ী ঢলের পানি চারদিকে যেতে পারেনা।

বাঁধের কারণে পানি বাধাগ্রস্থ হয়ে ধোপাজান নদী অতিক্রম করে সরাসরি একদিকে সুরমা নদীতে এসে প্রবল শ্রোতধারায় পতিত হয়ে প্রথমেই আঘাত হানে সুনামগঞ্জ পৌরসভা ও শহরতলীর ইব্রাহিমপুর মইনপুর হালুয়ারঘাট বাজারসহ সুরমা পাড়ের দুই তীরের জনবসতি বাজারসহ সরকারী বেসরকারী স্থাপনার উপর।

তারপরও সরকারী বরাদ্দ লুটতরাজের উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছে পাউবো ও পিআইসির লোকজনেরা। বাপ-পুতের পিআইসি দিয়ে সরকারী বরাদ্দ লুটপাটের এ মহোৎসবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সুরমা,জাহাঙ্গীরনগর ও রঙ্গারচর ইউনিয়নের লাখো মানুষ।

১৫-২০ জুনের দ্বিতীয়বারের বন্যায় মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ইব্রাহিমপুরসহ নদীরপাড়ের গ্রামগুলিতে। ৩ ইউনিয়নের লোকজনের চলাচলের প্রধান রাস্তা ইব্রাহিমপুর-ডলুরা বোর্ডার হাট ও হালুয়ারঘাট রাস্তা প্লাবিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন এবারের দুদফা বন্যায় প্রথম ভিকটিম ইব্রাহিমপুর,সদরগড়,জগন্নাথপুর ও মইনপুর গ্রামের বাসিন্দারা। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মানুষ বন্যার ৫ দিনেও কোন সহায়তা পায়নি।  

স্থানীয় বাজারগুলোতে বন্যার্তদের ভীড়ের সুযোগে অসাধূ ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধগতি আরোপ করেছিলো। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে। ২০ টাকা প্যাকেটের মোমবাতি ২শত টাকায়, ২০ টাকার ল্যাম্প বাতি ১০০ টাকায়, ১০০ টাকার হারিকেন ৫শত টাকায়, ৫ টাকার সিগারেট ১৫ টাকায়, ৬০ টাকা কেজির চিড়া ১৫০ টাকায়, মুড়ি কেজি প্রতি ২৫০ টাকায়, ২০ টাকা লিটারের পানি ৫০ টাকায়, ২০ টাকা কেজির আলু ৬০ টাকায়, ৮০ টাকা কেজির ডাল দেড়শ টাকায়, ৭০ টাকা লিটারের কেরোসিন ১০০ টাকায় বিক্রি করেছে শহরের চিহ্নিত সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা।

এছাড়া ১৪০০ টাকা মূল্যের গ্যাস সিলিন্ডার ৪০০০ টাকায় বিক্রয় করা হয়েছে। জেলা সদরের মধ্যবাজার,পশ্চিম বাজার,জেলা সদর হাসপাতাল পয়েন্টের দোকানগুলো এক একটা কসাই খানায় পরিণত হয়েছিল গত ৬দিনে।   

উল্লেখ্য এর আগে প্রথম দফায় গত ১৭ মে মঙ্গলবার সকাল থেকে সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছিল। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা বন্যায় সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলো। সরকারী হিসেবেমতে জেলার ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে ২৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যাণ নিরুপন করতে হলে প্রশাসনকে আরো সময় নিয়ে মাঠ পর্যায়ে জরীপ চালাতে হবে। তবে জেলার সকল শ্রেণিপেশার মানুষের অভিমত দ্বিতীয় দফা বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

কেবলমাত্র দুর্যোগ পরবর্তী স্থায়ী পূণর্বাসন, নদীখনন ও বহুতল ভবনে মানুষের উপযুক্ত আশ্রায়নই এ ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও লাগব করতে পারে।

এবি//দৈনিক দেশতথ্য//জুন ২১,২০২২//