বসুন্ধরা গ্ৰুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের চেয়ারম্যান সায়েম সোবহান আনভীরকে হত্যা চেষ্টার অপরাধে সাইফুল ইসলাম সাদ (২৩) নামের এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। আটক সাদের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়।
রাজধানীর ভাটারা থানা পুলিশ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাউতুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে তাকে আটক করেছে। অভিযোগটি তদন্ত করছেন ভাটারা থানার এসআই ও তদন্ত কর্মকর্তা হাসান মাসুদ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাদ জানিয়েছে, শুক্রবার (৫ নভেম্বর) জুমার নামাজ চলাকালীন সায়েম সোবহান আনভীরকে গুলি করে হত্যা করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। পটিয়ার সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এবং তার ছেলে নাজমুল করিম ওরফে শারুন চৌধুরী তাকে এই নির্দেশ দিয়েছে বলে সে স্বীকার করেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে সাদ আরও বলেছে, শারুন বলেছে জুমার নামাজের সময় সায়েম সোবহান আনভীরকে সরাসরি গুলি করে দিতে। বাইরে তাদের গাড়ি অপেক্ষা করবে। মসজিদ থেকে দ্রুত পালিয়ে যাতে ওই গাড়িতে উঠে যেতে পারি, সে ধরনের ব্যবস্থাও ছিল বলে জানায়।
ভাটারা থানার সুত্র জানায়, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে হত্যার পরিকল্পনার খবর পেয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে সাইফুল ইসলাম সাদকে আটক করা হয়।
গতকাল শুক্রবার তাকে আদালতে সোপর্দ করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রায় তিন মাস ধরে বসুন্ধরা এমডিকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছিল। অন্তত চারবার ছদ্মবেশে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি হাউজে ঢোকে সাদ। হুইপ সামশুল হক ও তার ছেলে শারুনের নির্দেশনায় কিভাবে আনভীরকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো তার বিস্তারিত বর্ননা দিয়েছে সাদ। কয়েকবার ব্যর্থ হয়ে শেষপর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশ ধরে। ভর্তি হয় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাউতুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানায়। কারণ সেই মাদ্রাসা থেকে প্রতিদিন বসুন্ধরা এমডির বাসায় কোরআন খতমের জন্য শিক্ষার্থীরা আসেন। সেই দলের সঙ্গে মিশে জুমার নামাজ পড়ার সময় বসুন্ধরা এমডিকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য শেষ চেষ্টা করে।
মাদ্রাসা অধ্যক্ষ মুফতি মিসবাহ উদ্দিন সগির জানান, কিছুদিন ধরে সাদের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল। সে ফোনে কথা বলার সময় ঘুরেফিরে তার মুখে হুইপ এবং শারুনের নামটি শোনা যেত। এরপর সাদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখছিলেন অধ্যক্ষ। হুইপ ও শারুন চৌধুরীর পরিকল্পনায় সাদ যে বসুন্ধরার এমডিকে হত্যার মিশন নিয়ে এখানে এসেছিল, তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তিনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মীদের বিষয়টি অবহিত করেন।
এ ঘটনায় গতকাল শুক্রবার ভাটারা থানায় বসুন্ধরা গ্রুপের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মেজর (অব.) শেখ মিজানুর রহমান বাদি হয়ে মামলা করেছেন। অভিযোগে সাদ ছাড়াও হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও তার পুত্র শারুন চৌধুরীকে আসামি করার আবেদন করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এর আগেও কয়েক দফা এ ধরনের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল চক্রটি।
মামলার বাদি মিজানুর রহমান জানান, হুইপ সামশুল হক ও তার ছেলে শারুন বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিকে হত্যার নীলনকশা করে। এ জন্য তাদের আস্থাভাজন পটিয়ার যুবক সাইফুল ইসলাম সাদকে কৌশলে দিনমজুরের ছদ্মবেশে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি হাউজে পাঠায়। বিভিন্ন কাজের সুবাদে সে এমডি হাউজে চারবার প্রবেশও করেছিল।
তিনি জানান, সাদ নিয়মিত বাড়ির বাইরে গিয়ে খামার থেকে এমডি হাউজে দুধ নিয়ে আসার কাজ করতো। পরিকল্পনা মোতাবেক সাদকে ওই দুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন শারুন। কিন্তু কয়েক দফা পরিকল্পনায় তা ভেস্তে যায়। এরপর বসুন্ধরার এমডিকে শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার সময় ছুরি মেরে খুন করার প্রস্তুতিও ছিল তাদের। তবে অনুকল পরিস্থিতি না থাকায় সাদ ওই পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
জিজ্ঞাসাবাদে সাদ জানিয়েছে, সে চট্টগ্রামের পটিয়া সেন্ট্রাল হাই স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় হুইপ সামশুলের ক্যাডার হান্নান ও মান্নানের সঙ্গে পরিচয় হয়। হান্নান ও মান্নান একপর্যায়ে সাদকে সামশু এবং শারুনের কাছে নিয়ে যায়। সামশুল ও শারুনের নির্দেশনায় এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই সে পরিচয় গোপন করে বসুন্ধরা এমডির বাসায় কাজ নিয়েছিল। এ ছাড়া হুইপের সঙ্গে সাদের ঘনিষ্ঠ ছবিও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ছদ্মবেশে দিনমজুর হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি হাউজে কাজ নেয়। এমডি হাউজে প্রবেশের সুযোগ হাতের নাগালে চলে আসার খবরটি মুহূর্তেই চলে যায় হুইপ সামশুর ক্যাডার হান্নান ও মান্নানের কানে। এরপর শারুন চৌধুরীর সঙ্গে সাদের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন তারা। ওই বৈঠকে বসুন্ধরা এমডিকে হত্যার পরিকল্পনার কথা সাদকে জানায় শারুন এবং তার বাবা। কাজটি করে দিলে সাদের পুরো জীবনে আর কিছু করা করা লাগবে না বলেও টোপ ফেলেন পিতা-পুত্র। সেই মিটিংয়ে সাদের হাতে নগদ ২০ হাজার টাকা তুলে দেন শারুন। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আরও টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়।
মামলার অভিযোগের তথ্য মতে, চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় গত দুর্গাপূজার ছুটিতে সাদ যখন বাড়িতে যায়। গত ১০ অক্টোবর ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামে যায় সাদ। ১২ দিন ছুটি কাটিয়ে ২৩ অক্টোবর কর্মস্থলে ফিরে আসে। ছুটিতে যাওয়ার পর শারুনের সঙ্গে সাক্ষাত হয় সাদের। এ সময় সাদকে একটি পিস্তল দিয়ে বসুন্ধরার এমডিকে গুলি করে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক ৫ নভেম্বর গতকাল (শুক্রবার) নামাজ পড়ার সময় বসুন্ধরার এমডি আনভীরকে গুলি করে হত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সাদ।
সূত্র জানায়, বসুন্ধরা গ্ৰুপের এমডিকে হত্যার পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সাদকে বড় ধরনের পুরস্কৃত করার আশ্বাস দিয়েছিল শারুন চৌধুরী। আর ব্যর্থ হলে তাকেই প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। থানা-পুলিশ ম্যানেজ করারও আশ্বাস দেওয়া হয় তাকে। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে গত দুটি জুমার নামাজে সঙ্গে পিস্তল নিয়ে রেখেছিল সাদ। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় সফল হয়নি।

Discussion about this post