এস এম জামাল, কুষ্টিয়া: কেরামত আলী। মেধা মননে আর সৃজনশীলতায় এক অনন্য ব্যাক্তি তিনি। বুদ্ধিদীপ্ত তার তীক্ষ্ণ মেধা দিয়ে সুদক্ষ আসবাবপত্রের কারিগর হিসেবে পরিচিতি বেশ।
ভালো কাঠমিস্ত্রি হিসেবে আশপাশ এলাকায় তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে এক ছেলে ও এক মেয়েকে মানুষ করেছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।কিনেছেন আবাদী কিছু জমিও। সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। জীবন সায়াহ্নে এখন সে বড্ড ক্লান্ত।
এতোক্ষণ বলছিলাম কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মশান গ্রামের কাঠমিস্ত্রী মো: কিরামত আলী ওরফে কিরন কালের কথা।
তিনি মেধা-মননে এক সৃজনশীল মানুষ হলেও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তাই এলাকাবাসী তাকে কিরন কাল বলেও ডেকে থাকে। ইশারায় কথা বলেন তিনি।
এই প্রতিবন্ধিতাকে এই হার না মানা গল্পের কারিগর কেরামত আলী স্ত্রী এক পুত্র দুই কন্যা সন্তানের জনক কষ্টের হাড়ভাঙা খাটুনি পরিশ্রম দিয়েই তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তার আবাসন মাঠে কিছু জমি ও কিনেছেন ছেলেটাকে পড়ালেখা করে মানুষের মত মানুষ করবে
তার পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, কেরামত আলী দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ালেখার সময় হঠাৎই কালাজ্বর নামক ব্যাধি তার শরীরে বাসা বাঁধে। তারপর থেকেই এই শিশুটি আর কথা বলতে কিংবা শুনতে পারে না। তার বাবা মৃত: আকবর আলী মিস্ত্রি। পরবর্তীতে বাবা মিস্ত্রির কাজে সহযোগী হিসেবে শুরু করেন। এভাবেই কাজ করতে করতে পরিপুর্ণ ভাবে মিস্ত্রি বনে যান তিনি। কিরামত আলীর বাবার বাড়ী ভেড়ামারা উপজেলায় হলেও বিয়ের পর মিরপুর উপজেলার মশান গ্রামে চলে আসেন। এবং এখানেই কাঠমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন। এভাবেই চলছে তার জীবনযুদ্ধ।
বারুইপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, যখন তার অন্যান্য বন্ধুদের (কালা বোবাদের) সাথে ইশারা ভাষায় কথা বলে তখন অনেকেই কৌতুহল বশে সেই দৃশ্য উপভোগ করেন। আমার ইউনিয়নে যে কয়জন বোবা রয়েছে তাদের মধ্যে কিরামত আলী ব্যতিক্রম। তার হাতের কাজের প্রশংসা গোটা ইউনিয়নে। আমি আমার ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন অস্বচ্ছল বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় ভাতার কার্ড প্রদান করেছি।
তার ছেলে মো: জামাল উদ্দিন (এস এম জামাল) বলেন, আমি ছোটবেলায় দেখতাম বাবা কথা বলতে পারে না। যখন বাবার সাথে বাজারে (হাটে) যেতাম। তখন লোকে হাসতো। আলু, পটল,পেয়াজ,মরিচ কিনতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। কিন্তু আমি থাকলে সে সমস্যা আর হতো না। ১ কেজি আলু কিংবা এক পোয়া মরিচ আমি বলতাম। আর বাবা শুধু টাকাটা দিতো। স্কুলে পড়তে গেলে অনেকেই বলতো পাগলের ছেলে। তখন কষ্ট পেতাম। আর এখন সেসব কষ্ট পাইনা। কারন আমার বাবাকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।সততার সাথে আমাদের মানুষ করেছেন। তিনি আরও বলেন, টিনের খুপড়ি ঘরে বড় হয়েছি। কিন্তু বাবা চাইতেন আমি যেন ভালো করে পড়ালেখা করি। বাড়ীতে কাঠের কাজ করলেও কখনো কাঠের যন্ত্রপাতি হাত দিতে দিতেন না তিনি। কারন বাবার ইচ্ছা আমি যেন পড়ালেখা শিখে মানুষের মতো মানুষ হই। এভাবেই আস্তে আস্তে সেই খুপড়ি ঘর মোটামুটি ভালো একটা অবস্থানে আসতে পেরেছে। আমি আমার বাবাকে খুব ভালোাবসি। বাবাই যেন আমার পুরো পৃথিবী।
কুষ্টিয়া ও কুষ্টিয়া মুখ ও বধির সংঘের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রহমান সুমন বলেন, কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তত দইশোরৃও বেশি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী রয়েছে।তিনি বলেন, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। তাদেরও পরিবার পরিজন আছে।তারাও সাধারনের মতো জীবনযাপন করেছেন। তবে তাদের সহযোগীতার জন্য যেন সংশ্লিষ্টরা এগিয়ে আসে এই কামনাই করেন তিনি।
আজ (৩ ডিসেম্বর) সারা দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৫০ হাজাররেরও উপরে।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//