Print Date & Time : 8 June 2025 Sunday 8:58 am

বিয়ানীবাজারে অরক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন: তরুণ প্রজন্ম চেনেনা গণকবরের স্থান

আমিনুল হক দিলু,বিয়ানীবাজার:১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহিদদের স্মৃতিবিজড়িত বদ্ধভূমিগুলো সংরক্ষণের অভাবে বিয়ানীবাজার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এতে শহিদদের বীরত্বগাথা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস বিলীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শহিদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, সরকারিভাবে যদি এসব স্থাপনা সংরক্ষণ করা হয় তবে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে স্বাধীনতার ইতিহাস।

স্বাধীনতার এত বছর পার হওয়ার পরও বিয়ানীবাজারে মুক্তিযুদ্ধের নানাস্মৃতিচিহ্নসহ অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে বধ্যভূমি, গণকবর, টর্চার সেলসহ অনেক স্থান। ঐতিহাসিক এসব স্থানের অধিকাংশই স্থানীয় কোন প্রবীন ব্যক্তি দেখিয়ে না দিলে তরুণ প্রজন্মের চেনার উপায় নেই! কোন কোন স্থান নিয়ে রয়েছে দ্বিমত, আবার অনেক স্থানের কথা সঠিকভাবে কারও মনে নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালীর গৌরব ও শহীদ স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে বিয়ানীবাজারে নির্মিত হয়েছিল কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু পরিচর্যা ও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে শহীদের স্মৃতি রক্ষার উদ্দ্যেশ্যে নির্মিত এসব স্তম্ভের বেশীরভাগই মর্যাদা হারাচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বিয়ানীবাজার উপজেলায় যুদ্ধের করুণ স্মৃতির স্বাক্ষী কাঁঠালতলা বধ্যভূমি অবহেলায় পড়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোন ভবনের অর্ধনির্মিত পিলার, কিংবা ভিত্তি প্রস্তর। পাশেই শৌচাগার, পয়নিষ্কাশন নালা, চলাচলের রাস্তা আর সরকারি ভবন। কাছে এসে ফলকের গায়ে লেখা না পড়ে চেনার উপায় নেই যে এটি একটি বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধ চলকালীন সময়ে পাক বাহিনীর বর্বরতার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে বিয়ানীবাজার উপজেলা কমেপ্লক্সস্থ কাঁঠালতলা বধ্যভূমি। এই স্থান থেকে স্বাধীনতার পর উদ্ধার করা হয়েছিল শতাধিক লাশ, নর কংকাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট মাস থেকে স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনারা এখানে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের স্বজন ও নিরীহ লোকদের ধরে এনে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা মুক্তিকামী, নিরীহ মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছিল নির্বিচারে। এরমধ্যে দেশের একমাত্র প্রবাসী বাউল শিল্পী শহীদ কমর উদ্দিন রয়েছেন। ধরে নিয়ে আসা অনেককেই নিজ হাতে নিজের কবর খোড়তে বাধ্য করা হতো বলে বেঁচে যাওয়া নির্যাতিতরা জানিয়েছেন।

পাশবিক নির্মমতার সাক্ষী এ বধ্যভূমিতে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন ভবন, শৌচাগার এবং পয়নিস্কাশন লাইন রয়েছে। অথচ যুদ্ধের পর এই স্থানটিতে কোন স্মৃতি চিহ্ন স্থাপন না করে নির্মাণ করা হয়েছে ভবন, শৌচাগার। অনেক চেষ্টার পর এখানে একটি স্মৃতি ফলক নির্মিত হলেও তা থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে। বর্তমান প্রজন্ম এ স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলদ্ধি করা তো দুরে থাক, এখানে কী ঘটেছিল সে কথাও জানেনা। প্রায় নিয়মিত এই স্থান দিয়ে আসা যাওয়া করেন এমন কয়েকজনকে কাঁঠালতলা বধ্যভূমির বিষয়ে জানতে চাইলে তারা এর অবস্থানও বলতে পারেননি।

জানা গেছে, এরশাদ সরকালে আমলে ১৯৮৪ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৮৬ সালে পল্লী উন্নয়ন ভবন (বধ্যভূমির উপর) নির্মিত হয়েছে। স্থানীয়দের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীণন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা আফজালুর রহমান কাঁঠালতলার এ বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করেন। নির্মিত ফলকটির গায়ে লেখা রয়েছে- ‘পাক সেনারা জানা-অজানা অনেককে এখানে ধরে এনে হত্যা করেছে।’

মুক্তিযুদ্ধে বিয়ানীবাজারের স্মৃতি বিজড়িত একটি স্থান সড়ক ও জনপথ ডাকবাংলো। বিয়ানীবাজারের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটি এই স্থান থেকেই রওয়ানা হয়েছিল, আর ডাকবাংলোর রান্না ঘর ছিল পাক বাহিনীর টর্চার সেল। এপ্রিলের শুরুতে বিয়ানীবাজার থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ প্রত্যশী ৪০জনের প্রথম দলকে প্রশিক্ষণ দেয়ার আগে সওজ ডাকবাংলোর টিলার উপরে ৪০জন তরুণ যুবককে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়। এসময় উপস্থিত জনগণও মাটিতে হাত রেখে শপথ নেন। পাকবাহিনী বিয়ানীবাজারে অবস্থানকালে এই ডাকবাংলো হয়ে উঠে তাদের অপকর্মের প্রধান আস্তানা। ডাকবাংলো ছিল পাকবাহিনীর ক্যাম্প। ক্যাম্প প্রধান ক্যাপ্টেন ইফতেখার হোসেন গন্দল এখানেই অবস্থান নেয়। বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের ধরে এখানে আনা হতো গন্দলের লালসা পূরণ করতে। বাংলোর চত্বরে মাদুর বিছিয়ে বসতো শান্তি কমিটির মজলিসে শুরার বৈঠক। চলতো হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ আর ধর্ষণের পরিকল্পনা। আর হত্যার পূর্বে ডাকবাংলোর চত্বরের কাঠাল গাছের ডালে ও রান্না ঘরের কড়ি বর্গায় মানুষকে উল্টো করে ঝুলিয়ে চলতো অকথ্য নির্যাতন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিক উদ্দিন বলেন, আমাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন আনছার বাহিনীর বিয়ানীবাজার থানা কমান্ডার কাজী আলাউদ্দিন। ডাকবাংলো ও রসুই ঘর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য স্মৃতি। এই স্থানটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পাকবাহিনীর নির্মমতার কথা দৃশ্যমান করে লিপিবদ্ধ করা উচিত। এতে করে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে।

বিয়ানীবাজার উপজেলার মুড়িয়া ইউনিয়নের পূর্ব মুড়িয়ায় একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্ন সারপার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টর্চারসেলকে স্মৃতিসৌধে রূপান্তর করা হলেও নয়াগ্রাম এলাকার গণকবর এখনও অবহেলা ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৭১ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলার পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী মানুষের একমাত্র সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল পূর্ব মুড়িয়া এলাকায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়িত করে পাকিস্তানি হানাদাররা দখল করে পূর্ব মুড়িয়া এলাকা। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় মুক্তিকামী মানুষদের সারপার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এনে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া এবং আরো কয়েকজনের লাশ নয়াগ্রামের বর্তমান বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন সুনাই নদীর চর ও আশেপাশের বিভিন্ন গর্তে এনে গণকবর দেয়া হয়।

উপজেলার বৈরাগীর ত্রিমূখী নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জামালের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হয় ‘শহীদ জামাল স্মৃতি স্তম্ভ। এটি বিয়ানীবাজারে নির্মিত প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ। গঠিত হয় শহীদ জামাল স্মৃতি সংসদ নামে একটি সংগঠনও। কিন্তু স্বাধীন দেশেও স্বস্থানে টিকে থাকতে পারেনি এই স্তম্ভটি। স্তম্ভটির পাশেই গড়ে উঠেছে পান-সিগারেটের দোকান। আর এসব ভ্রাম্যমান দোকানের ভিড়ে অনেকটা আড়ালেই থেকে যায় স্তম্ভটি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে উপজেলার রাধু টিলা (বর্তমান নাম শহীদ টিলা)’য় পাক হানাদার ও তাদের দেশীয় দোসররা এই স্থানে হত্যা করে সুপাতলা গ্রামের ঘোষ পরিবারের ১২ সদস্যকে। এখানেই হত্যা করা হয় মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ উদ্দিন, বিয়ানীবাজার পৌরসভার সাবেক প্রশাসক তফজ্জুল হোসেনের পিতা ও ভাইকে। এছাড়া আরও কয়েকজনকে এখানে হত্যা ও মাটি চাপা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর রাধু টিলায় স্থাপিত হয়েছিল স্মৃতিসৌধ। শহীদ পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ জাকির হোসেন জানান, পাকিস্তানীদের নির্যাতনে নিহত তার পিতা ও ভাইয়ের স্মৃতিফলক এখানে নির্মাণ করা হয়েছে।

স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত দার্শনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জিসি দেব) স্মরণে এই স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছিল উপজেলার লাউতা গ্রামে তাঁর নিজ পোত্রিক ভিটায়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে এটির দশাও জরাজীর্ণ। তাঁর বাড়ি নিয়েও রয়েছে নানা জটিলতা। স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলায় বেদখলে রইয়ে গেছে বাড়িটি। বুদ্ধিজীবী দিবসে জিসি দেব স্তম্ভে পুষ্প শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়া, বছরের অন্যান্য দিনে এখানে কোন কর্মসূচি চোখে পড়েনা।

এছাড়াও বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাই গদারবাজার ও মুড়িয়ার গণকবরগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। দুবাগ, শেওলা ও আলীনগরসহ প্রভৃতি স্থানের গণহত্যার কথা এখন প্রবীনদের গল্পেই বিদ্যমান। অধিকাংশই স্থানীয় কোন প্রবীন ব্যক্তি দেখিয়ে না দিলে চেনার উপায় নেই। কোন স্থান নিয়ে রয়েছে দ্বিমত আবার অনেক স্থানের কথা সঠিক কারো মনে নেই। এগুলো জনসম্মুখে তুলে ধরার বিষয়টি কেউ বিবেচনাই করছেনা!

বিয়ানীবাজার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ কাদির বলেন, সময়ের পরিক্রমায় রাধু টিল্লা, কাঁঠালতলা বধ্যভূমি ও সারপার স্কুলের টর্চারসেল সংরক্ষিত হলেও এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিচিহ্ন। শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই নয়, ব্যক্তি কিংবা সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগেও এসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

খালিদ  সাইফুল // দৈনিক দেশতথ্য // ২৫ মার্চ ২০২৪