Print Date & Time : 5 July 2025 Saturday 8:37 pm

বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস: বর্তমান বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত

উম্মে সালমা শাম্মি: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২হাজার ৫৫৪ ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ২, ১৯, ৪১৪.১৪ টাকা। যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ছিল ২০ হাজার ২২৭ ডলার। সেই হিসেবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩২৭ ডলার। মাথাপিছু আয় বাড়ার এ চিত্র আদৌ কতটা মাথাপিছু তা প্রশ্নবিদ্ধ রয়েই যায়। মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের নিকট দেশের সমগ্র সম্পদের ৮০ শতাংশ পুঞ্জিভুত থেকে গেলে বাকি ২০ শতাংশের বন্টনে কিভাবে মাথাপিছু বিষয়টা নিশ্চিত হয় সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
আরেকটা পরিসংখ্যানের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। বিবিএসের তথ্যমতে, দেশে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ দাড়ায় ২৪ হাজার ৮৯০ টাকা। বাস্তবিক অর্থে ঋণের এ বোঝার অনেকটাই অপ্রকাশ্য। যে সংখ্যা খালি চোখে দেখা যাচ্ছে, চিত্র তার বেশি বৈকি কম নয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি যেমন আমাদের রাতারাতি আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখাচ্ছে পক্ষান্তরে মাথাপিছু ঋণের বোঝা এক নিমিষেই যেন আমাদের মাটিতে ছুড়ে ফেলছে।
বিশ্ব সমাজকর্ম দিবসের আলোচনায় এসব প্রসঙ্গ টেনে আনার হেতু কি? সমাজকর্ম এমন একটি পেশা, যার দর্শন, বিষয়বস্তু সমাজে পরিকল্পিত পরিবর্তনের কথা বলে। আর ঠিক এজন্যই সমাজকর্মীদের “চেইঞ্জ এজেন্ট” বলা হয়।
রাত পোহালেই আমরা আমাদের অজান্তে যে বড়লোক হয়ে যাচ্ছি তার চিত্র এখন পত্রিকার পাতা তথা প্রিন্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল মিডিয়ায়় সরগরম। একটি মাল বোঝাই ট্রাক যার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী আর যাকে কেন্দ্র করে শত শত মানুষের ভিড় এটি এখন রোজকার চিত্র। কখনোবা এ নিয়ে মারামারি, চুলোচুলি। আর তা যদি হয় কোন সংবাদের রিপোর্ট কিংবা ভিডিও ক্লিপ তার সাথে যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক টা থাকে তা কি যে নিদারুণ ঠিক যেন বুকে এসে বাঁধে। যাদেরকে আমরা এভাবে দৌড়াতে দেখছি তাদের পোশাক আশাক ও বেশ উন্নত ধরনের। এরা আসলে কারা? এরা আসলে আর কেউ নয়, আমাদের দেশেরই বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী; যারা দেশের ৭০ ভাগেরও বেশি জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর আকাশচুম্বী মূল্যের ভয়াল থাবা আজ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদাগুলোও অনেকাংশে মেটাতে পারছে না, পারছে না তাদের নিত্যনৈমিত্তিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে।
এবছর বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস পালিত হতে যাচ্ছে আজ ১৫ই মার্চ। প্রতিবছর মার্চ মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম দিবস পালিত হয়। এ বছর বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম দিবস উদযাপনের যে প্রতিপাদ্যটি ঠিক করা হয়েছে তা হলো” একটি নতুন ইকো সামাজিক বিশ্ব গড়ে তুলিঃ কাউকে পিছনে না রেখে”।
নতুন ইকো সামাজিক বিশ্ব এ প্রত্যয়টির ধারণা মূলত এমন যে “জাতিবিশেষ তথা দেশ বিবেচনায় ” সে দেশের জন্য গৃহীত নীতিমালা, চর্চিত মূল্যবোধগুলো এমন হবে যেন দেশের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বাস ও আস্থার একটি জায়গা তৈরী হবে। সেই সাথে সাথে এ ধরনের পদক্ষেপ মানব সৃষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি হ্রাস করে টেকসই উন্নয়ন কে ত্বরান্বিত করবে। আর এই উন্নয়ন হবে কাউকে পেছনে না ফেলে।” এ যেন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এক অলীক কল্পনা। বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্য করা যায়, একপেশে যে উন্নয়নে ছয়লাব এদেশ, তা দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ছাপিয়ে উন্নয়নের নামে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। ঠিক এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আজ আমরা উদযাপন করছি বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। বাংলাদেশে যা আজও পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু বিশ্বের বহু উন্নত দেশে এটি পেশা হিসেবে স্বীকৃত, শুধু স্বীকৃতই নয় বরং সমাজকর্ম বেশ সফলভাবেই পরিকল্পিত পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়নে চালিকাশক্তি হিসেবে চর্চিত হয়ে আসছে। সমস্যায় জর্জরিত আমাদের সোনার মাতৃভূমিতে ও সমাজকর্ম কে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি সমাজকর্ম অনুশীলন ও গবেষণায় যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সরকারের আরো বেশি যত্নবান হওয়া উচিত। সমাজকর্ম চর্চায় জড়িত ব্যক্তিদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। তবেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তথা কাউকে পিছনের না ফেলে যে উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে তা অনেকাংশে বাস্তবে রূপান্তরিত হবে বলে আশা করা যায়। দেশের নীতিনির্ধারকগণ যখন সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার উপর পরিচালিত সমাজকর্ম গবেষণায়় প্রাপ্ত ফলাফল বিবেচনায় নয়ে প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ করবেন, ঠিক তখনই ইকো সামাজিক বিশ্ব তথা টেকসই উন্নয়নের দিকে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবো।
আর এর অন্যথা হলে, ঘুনে ধরা এ সমাজের মাথাপিছু আয় বাড়বে বটে, মানুষগুলোর পেটে খাবার থাকবেনা; থাকবেনা কোন বিনোদনের ব্যবস্থা। এক পার্শ্বিক উন্নয়নের এক করালগ্রাসে দেশ নিমজ্জিত হবে। মানুষ নিজেদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ব ভুলে গিয়ে আরো বেশি অপরাধ প্রবণ হয়ে় উঠবে। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকৃত ব্যবহার ও যথোপযোগী ব্যবহার যা কিনা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ বলে বিবেচিত হয়, মানুষ সেটা ভুলে গিয়ে় প্রাকৃতিক উপাদানের ক্ষতিসাধন করতে থাকবে। আর এটা মোটেও কাম্য হতে পারে না। পরিকল্পিত পরিবর্তনের এই তো সময় এবং তা অবশ্যই হতে হবে সমাজকর্ম পেশার অনুশীলন কে সঙ্গে নিয়ে। বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম দিবস উদযাপনের তাৎপর্য সফল রূপ নিবে তখন, যখন বিশ্বের প্রতিটি দেশ তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাকৃতিক উপাদান কে মাথায়় রেখে জনসংখ্যার চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করবে। এর ফলে একদিকে যেমন সামগ্রিক ও সার্বজনীন অংশগ্রহণের জাতীয়় উন্নয়ন নিশ্চিত হবে এর পাশাপাশি চূড়ান্তভাবে বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন আরো বেশি বেগবান হবে। তবেই না গড়ে তোলা সম্ভব একটি ইকো সামাজিক পৃথিবী।

লেখক পরিচিতি:এম.এস.এস. (সমাজকর্ম)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।