নাজিবুল বাশার, মধুপুর (টাঙ্গাইল) :
লাল মাটি এলাকা টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়। আনারসের রাজধানী হিসেবে বেশ খ্যাত মধুপুর। এ গড় এলাকা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ ও গাজীপুরের কিছু অংশ নিয়ে। পাহাড়ি অঞ্চল উচু বন্য মুক্ত। বেশির ভাগ অংশ জুড়ে ছিল শালবন। এ অঞ্চলের ভু-প্রকৃতি আবহাওয়া জলবায়ু আনারস চাষের বিশেষ উপযোগী। মধুপুরের এক গারো নারীর হাত ধরেই শুরু হয় প্রথম আনারস চাষ। ধীরে ধীরে হানিকুইন ও জায়েন্ট কিউ জাতের আনারস চাষ বিস্তার লাভ করে। সারাদেশে মধুপুরের আনারস খ্যাতি লাভ করে।
মধুপুর হয়ে উঠে আনারসের রাজধানী। ২০২১ সালে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি মধুপুরে ফিলিপাইনের আনারসের জাত সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে এমডি-২ সুপার সুইট জাতের চারা এনে কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দেন। দুই বছরে নতুন জাতের আনারস কৃষকদের মাঝে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এ বছর অনেক কৃষকের বাগানে আনারস ধরেছে। নতুন এ জাতের আনারসকে ঘিরে স্বপ্ন বুনছেন মধুপুর গড় এলাকার দুইশতাধিক কৃষক।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ফিলিপাইনের এমডি-২ সুপার সুইট আনারসটি মধুপুরে এর চাষ এই প্রথম। স্থানীয় সংসদ সদস্য কৃষিমন্ত্রী ফিলিপাইন থেকে চারা আমদানী করে এনেছেন।
কৃষিবিভাগ ২২৭ জন কৃষকের মাঝে এ চারা বিতরণ করেছে। মধুপুরে ২০২২-২০২৩ এ দুই অর্থ বছরে প্রথম পর্যায়ে ১০৭জন নির্বাচিত কৃষকদের মাঝে ৫ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫শ’ চারা বিতরণ করে। যা উৎপাদন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবছর ১০৭ জন কৃষকের মধ্যে অনেকের বাগানে আনারস পাকতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় ধাপে ১২০ জন কৃষকের মাঝে ২ লক্ষ ৭০ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মধুপুরে প্রায় ২২ হেক্টর জমিতে এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হয়েছে। নতুন জাতের আনারসের চারা নামে পরিচিত। সংগ্রহ প্রণালি দেশীয় জাতের থেকে ভিন্ন। প্রতিটি পরিপক্ব গাছের গোড়ায় দু’ তিনটি করে চারা জন্মে। কোনো ক্ষেত্রে এর অধিক হতে পারে। প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে এ চারা সংগ্রহ করতে ৬৯ হয়।
এ হিসাবে আগামী বছর প্রায় ১৮ থেকে ২০ লক্ষ দেশীয় এমডি-২ চারা উৎপাদনের সম্ভবনা রয়েছে। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিতরণ করা সম্ভব হবে।
সুপার সুইট জাতের এমডি-২ আনারস অন্যান্য সকল জাতের চেয়েও অধিক সুমিষ্ট এবং পুষ্টি গুণ সমৃদ্ধ। এমডি-২ আনারস ফিলিপাইনের মাউই আনারস কোম্পানি কর্তৃক উদ্ভাবীত এক প্রকার হাইব্রীড সুপার সুইট জাত। এ কোম্পানিটি বিভিন্ন প্রজাতির আনারসের জাত উন্নয়ন, প্রসেসিং ও গবেষণা করে থাকে। এ কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক ডিলার্ড। তার স্ত্রীর নাম ছিল মিল্লি। মিল্লির প্রথম বর্ণ এম এবং ডিলার্ড এর ডি এ প্রথম দুইবর্ণ মিলে এমডি-২ আনারসের নাম করণ করেন কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। তিনি তার স্ত্রীকে অধিক ভালোবাসার স্বীকৃতি স্বরূপ সারা বিশে^ নামটি স্বরণীয় করে রাখার জন্য নাম করণ করেন।
আনারসটি পুষ্টির বেশ বড় একটি উৎস। এমডি-২ সুপার সুইট জাতের আনারসে রয়েছে অন্যান্য জাতের আনারস থেকে অধিক পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাস। মানব দেহের পুষ্টির অভাব পূরণে কার্যকরী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণ, হাড়ের গঠন, দাঁত ও মাড়ি সুরক্ষা, চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, হজম শক্তি বৃদ্ধি, রক্ত জমাটে বাধা দেয়। হৃদপিন্ডে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত সরবরাহ কাজে সহায়তা ও ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নানা গুণে সমৃদ্ধ এ আনারস চাষে আগ্রহের শেষ নেই কৃষকের। নতুন এ জাত নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন কৃষকেরা। ইদিলপুর, আউশনার, মহিষমারা, গারোবাজার, পিরোজপুর ও ধরাটি গ্রামে গিয়ে দেখাযায় এমডি-২ জাতের আনারসের বাগান। গাছের ধরণ, আনারস ও চারা মধুপুরের আনারসের চেয়ে ভিন্ন। গাছের পাতা সতেজ। চারা বের হচ্ছে মা গাছের গোড়া দিয়ে। আনারস দেখতে লম্বা ও গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত ক্রমানুসারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখতে সুন্দর।
পীরগাছা গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান জানান, বিতরণ কালে চারা গুলো ছিলো ফ্যাকাসে। দেশীয় চারার চেয়ে নিন্ম মানের। তিনি ভাব ছিলেন এ চারা ভালো হবে না। ৫ হাজার চারা দেশীয় জাতের বাগানের পাশে রোপণ করে স্বাভাবিক যত্ন করেছেন। তার বাগানের আনারস পাকতে শুরু করেছে। তিনি প্রথমে আনারস খেয়ে দেখে আত্মতৃপ্তি পেয়েছে।
স্থানীয় বাজারে ১শ’ আনারস এনে প্রথমে দুটি আনারস কেটে বাজারের লোকজনকে খাওয়ালে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৩৫-৪০টাকা দামে বিক্রি হয়ে যায়। এভাবে কয়েক দিনেই তার বাগানের পাকা আনারস গুলো বিক্রি হয়ে যায়। তিনি আরও জানান এ নতুন জাতের আনারসের বাড়তি কোন যত্ন নিতে হয় না।
মহিষমারা গ্রামের বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক ছানোয়ার হোসেন জানান, তিনিও এজাতের আনারস চাষ করেছেন। এবছর ফলন মোটামুটি ভালো তবে তিনি আশা করছেন আগামী বছর আনারসের গাছগুলো এদেশের আবহওয়ার সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ হলে ফলন আরো বৃদ্ধি পাবে। তবে এনিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন।
আউশনারা কলেজের অধ্যক্ষ কৃষিবিদ কামরুজ্জামান জুয়েল বলেন, তার বাগানের এমডি-২ আনারসের ফলন এ বছর কম হলেও আগামীতে ভালো ফলন পাওয়ার আশা করছেন তিনি।
এবছর নতুন করে তিনি আরও দশ হাজার চারা রোপণ করেছেন। তার বাগানের আনারসের ওজন আধা কেজি থেকে প্রায় দুই কেজি পর্যন্ত হয়েছে। খেতেও সুমিষ্টি। তবে তিনি মোটেরবাজারের প্রান্তিক কৃষকদের বাগন থেকে এমডি-২ সংরক্ষণ করে বিদেশে রপ্তানি করারও পরিকল্পনা রয়েছে তার।
তবে এ আনারস চাষের শুরু থেকেই চলছিলো নানা ধরণের আলোচনা সমালোচনা। কেউ কেউ বলছিলো ফলন ভালো হবে না। গাছ ভালো হবে না। কেমন হয়। এনিয়ে কৃষক ও স্থানীয়দের মাঝে চলছিলো মিশ্রপ্রক্রিয়া।
এখন কৃষকরা বলছে, ফিলিপাইন থেকে আনারসের চারা আমদানীকরে দীর্ঘ সময়ে আনতে গিয়ে চারা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কৃষকরা এখন যে তাদের বাগান থেকে যে চারা উৎপাদিত সে চারায় কৃষকের স্বপ্ন পুরণ হবে এমনটাই ধারণা কৃষক ও কৃষি বিভাগের। এ সব তথ্য কৃষি বিভাগ, কৃষক ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন রাসেল জানান, মধুপুরে ২০২২-২০২৩ এ দুই অর্থ বছরে প্রথম পর্যায়ে ১০৭জন নির্বাচিত কৃষকদের মাঝে ৫ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫শ’ চারা বিতরণ করা হয়েছে। যা উৎপাদন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবছর নতুন করে ১২০ জন কৃষকের মাঝে ২ লক্ষ ৭০ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। এতে মোট প্রায় ২২ হেক্টর জমিতে এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হয়েছে। তিনি বলেন, এ জাতের আনারসের চারা নামে পরিচিত। সংগ্রহ প্রণালি দেশীয় জাতের থেকে ভিন্ন। প্রতিটি পরিপক্ব গাছের গোড়ায় দু’ তিনটি করে চারা জন্মে। কোনো ক্ষেত্রে এর অধিক হতে পারে। প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে এ ছাকা সংগ্রহ করতে হয়। তাঁর মতে, আগামী বছর প্রায় ১৮ থেকে ২০ লক্ষ দেশীয় এমডি-২ চারা বাচারা উৎপাদন হবে যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিতরণ করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, এ আনারস সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এ আনারসের মিষ্টতা, ভক্ষণ অংশ দেশীয় জাতের চেয়ে বেশী। লাইফ টাইম প্রায় ৩০ দিন এবং সার্বিক ভাবে সকল গুণাগুণ দেশীয় জাতের থেকে অধিক। এ আনরস কাতারে রপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে।
দৈনিক দেশতথ্য///এস//

Discussion about this post