মেহেরপুরে বোরো ধানে মাজরা পোকার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ধান চাষিরা। বিগত ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এবারের মত মারাত্মক আক্রমণ আর দেখেননি কৃষকরা। মাজরা দমনে বারবার কীটনাশক প্রয়োগ করা হলেও তা কাজে আসেনি।
এতে ধান আবাদে খরচ বৃদ্ধি হলেও ক্ষেতের ২০ থেকে ৩৫ ভাগ পর্যন্ত শিষ বিনষ্ট হয়েছে। ফলে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বেশ দুশ্চিন্তায় ধান চাষিরা । মেহেরপুর জেলা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি
মৌসুমে মেহেরপুর জেলায় বোরো ধানের লক্ষমাত্রা
নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ হাজার ১৭০ হেক্টর।
কিন্তু চলতি মৌসুমে বোরো আবাদে লক্ষমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ
কৃষি বিভাগ। মেহেরপুর জেলায় ১৮ হাজার ১৬৭ হেক্টর
জমিতে চাষ হয়েছে বোরো ধান। যা গত বছরের তুলনায়
প্রায় ২ হাজার হেক্টোর কম। প্রতি বছরের মতই এবারও
অনেকটা দেরিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে মেহেরপুর
জেলায়।
চাষিরা জানান, অন্যান্য জেলায় ধান কাটা শেষের
দিকে কিন্তু মেহেরপুর জেলায় এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি।
বোরো ধান কাটার আগেই থোরসহ শুকিয়ে যাচ্ছে ধানের
শীষ। চলতি মৌসুমে মেহেরপুর—চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের উপর
দিয়ে বয়ে গেছে তীব্র তাপদাহ। এতে বৃদ্ধি পেয়েছে
সেচ খরচ। একই সাথে কৃষকের সার, কীটনাশক ও শ্রমিক
খরচ বেড়েছে। ধানের শীষ বের হওয়ার পরে দেখা গেছে থোর থেকে শুকিয়ে গেছে। চলতি মৌসমে নানা ভাবে খরচ
বাড়লেও ভালো ফলনের আশা করেছিল কৃষকরা। কিন্তু এর সাথে আরও যুক্ত হয়েছে ধানের শীষ মরে যাওয়া। কৃষকরা বুঝতে পেরেছেন মাজরা পোকার আক্রমণের বিষয়টি।
প্রায় প্রতিটি মাঠেই পোকার আক্রমণে শীষ মরেছে।
প্রতিটি ধান ক্ষেতের ২০ থেকে২৫ ভাগ শীষ শুকিয়ে চিটা দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেতের ধান পাকা শুরু করেছে। মাজরার আক্রমণে শুকিয়ে যাচ্ছে ধানের থোড়। অতিরিক্ত গরম ও মাজরার আক্রমণের শীষের এই দুরাবস্থা । যা কোনভাবেই আর রক্ষা করা সম্ভব নয়। ফলে এবারের বোরো ধানের ফলন বিপর্যয় হবে বলে জানালেন কৃষকরা। মাঠভেদে আক্রমণের ধরণও আলাদা। কোন মাঠে হাইব্রিড জাতে বেশি আক্রমণ হয়েছে। আবার কোন কোন মাঠে অন্যান্য জাতের ক্ষেতে বেশি আক্রমণ।
সব গুলো ধানের জাতেই আক্রমণ হয়েছে। আক্রান্তেরহার
এতোটাই বেশি যে দূর থেকেই শুকিয়ে যাওয়া শীষ নজরে
আসছে। চাষিরা জানান, এ অঞ্চলে সাধারণত সাদা
মাজরার আক্রমণ দেখা দেয়। তাই চাষিরা অন্যান্য বছরের মতই মাজরা দমনে দেশের প্রচলিত কীটনাশক প্রয়োগ করেন।
তবে কীটনাশকে কাঙ্কিত ফলাফল না পাওয়ায় চাষিরা হতাশ হয়ে পরেছেন। এক পর্যায়ে তাদের নজরে আসে কাল মাথার মাজরার আক্রমণ । তবে তার আগেই মাজরা দমনের সময় শেষ হয়েছে। ফলে ক্ষতি মেনে নেওয়া ছাড়া চাষিদের কাছে অন্য কোন উপায় ছিলো না। চাষিরা জানান, বোরো ধানের জন্য মাজরা পোকা দমনের প্রচলিত কীটনাশক স্প্রে করা হয় এক থেকে তিন বার।
চাষিরা এবার ৫—৬ বার স্প্রে করেও মাজরার হাত থেকে ধান রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। অতিরিক্ত কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ বাড়লেও ফলন বিপর্যয়ে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা গাংনী উপজেলার গোপালনগর গ্রামের ধান চাষি রাহিল উদ্দীন জানিয়েছেন, আমার দুই বিঘা ধান রয়েছে। আমার ধানের অর্ধেক ধান প্রায় মাজরায় মেরে দিয়েছে। অর্ধেক অর্ধেক মাজরার মেরে দিয়েছে। শুধু আমার নয় আমাদের এই মাঠে অধিকাংশ কৃষকের ধানই মাজরার আক্রমণে ফলন হবে না, চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
একই এলাকার সেলিম রেজা জানিয়েছেন আমার ৬ বিঘা
ধান আছে, ব্যাপক মাজরা পোকার আক্রমণ । আমার ক্ষেতের বেশির ভাগ জমিতে মাজরার আক্রমণ। শীষ বের হওয়ার পর দেখি শুকিয়ে সাদা হয়ে আছে। শুধু আমার নয় আমার এলাকার শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের ধান এ পোকার আক্রমণে।
পূর্বমালসাদহ গ্রামের চাষি আক্তার হোসেন দুলাল
জানান, আমার নিজের ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধান
রয়েছে। এছাড়াও আমার একটি সেচ পাম্প রয়েছে। ঠিক
যে সময়ে অতিরিক্ত তাপদহ শুরু হল সেই সময়ে ধানের ক্ষেতে পানির চাহিদাও বারে। কিন্তু বিদ্যুৎ এর দেখা মিলতো না। বিদ্যুৎ অফিসের বার বার ফোন দিয়েও কোন সুরাহা মেলেনি। তারা বিভিন্ন দুই থেকে সবচ্চর্ তিন ঘন্টা
বিদ্যুৎ দিতো এতে করে আমরা চাষিদের ধানের ক্ষেতের
পানির চাহিদা মেটাতে পারেনি। তারপর দেখি কিছু
ক্ষেতের ধান শুকিয়ে কালো হয়েছে আবার কিছু ক্ষেতে
দেখি সাদা হয়েছে। পরে জানতে পারি এটা মাজরা
পোকার আক্রমণে এমন হয়েছে। বার বার সেচ ও কৃটনাশক প্রয়োগ করেও খুব একটা লাভ হয়নি।
কাল মাথার মাজরার বিষয়ে একমত পোষণ করে মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন, প্রচন্ড তাপদাহে কর্ম পরিবর্তন হয়েছে মাজরা পোকার ধরণ। তাই অতিরিক্ত ডোজ প্রয়োগের করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে মাজরার আক্রমণে ফলন বিপর্যয় হবে না বলে আশার কথা শোনালেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য, ১৬ মে ২০২৩