কম্পিউটার বেইজড মুদ্রণ ব্যবস্থার কারনে বিলুপ্তির পথে লেটার প্রেস বা ট্রাডেল মেশিন। বিলুপ্ত হতে চললেও কুষ্টিয়ার প্রকাশনা জগতে লেটার প্রেস আজও বেশ স্মরণীয় হয়ে আছে।
এখানকার যারা এক সময় লেটার প্রেসের মালিক ছিলেন তারা এনছেন আধুনিক প্রেস। যারা একসময় লেটার প্রেসে বসে গ্যালি সাজাতেন ব্লক মারতেন প্যাডেল মেরে মেশিন চালাতেন তাদের বেশিরভাগই প্রয়াত। যারা বেঁচে আছেন তাদের অনেকেই এখন কম্পিউটারে বসে কম্পোজ ও পেজ মেকাক করে থাকেন। নতুন প্রজন্মের অনেকেই লেটার প্রেসের কার্যক্রম দেখেননি। তাদের জন্যই দৈনিক দেশতথ্যের এই প্রতিবেদনের অবতারনা।
একজন লোক ছোটো একটি টুলে বসতেন। তার সামনের টেবিলের উপর, টেবিলের গা ঘেঁসে সামনে, ডানপাশে, বামপাশে ছোটো ছোটো অনেকগুলো খোপওলা কাঠের পাত্র থাকতো। সেইসব খোপে সিসা দিয়ে বানানো উল্টো করে তৈরি বাংলা বা ইংরেজি হরফ থাকতো। একেকটি খোপে একেক ধরনের হরফ থাকতো। টুলে বসা সেই লোকটি খোপ থেকে একটি একটি করে হরফ তুলে নিতেন। তারপর একটির পর একটি হরফ বসিয়ে শব্দ তৈরি করতেন। যেমন বই লিখতে হলে ‘ব’ হরফের খোপ থেকে ‘ব’ এবং ‘ই’ হরফের খোপ থেকে ‘ই’ হরফটি নিয়ে পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হতো ‘বই’ শব্দটি।
এভাবে অনেকগুলো শব্দ বসিয়ে একটি বাক্য তৈরি হতো। অনেকগুলো বাক্য দিয়ে একটি লেখা তৈরি করে ‘গ্যালি’ নামের একটি পাত্রে হরফগুলো রাখা হতো। গ্যালিতে রাখা সেইসব উল্টো হরফের গায়ে রোলার দিয়ে কালি লাগানো হতো। তারপর কালিমাখা সেইসব হরফের উপর বিশেষ একটি পদ্ধতিতে নিউজ প্রিন্টের একটি কাগজ চাপ দেয়া হতো। তখন সেই নিউজ প্রিন্টের কাগজে অক্ষরগুলো দৃশ্যমান হতো। তারপর চেক করা হতো বানান সেটিং সঠিক হয়েছে কি না।
ছাপা কাজে ভুলচুক হলে ভুল হরফ সরিয়ে সঠিক হরফ বসানো হতো। প্রুফ দেখার পর গ্যালিতে সাজানো হরফ মেশিনে সেট করে কাগজে ছাপানো হতো। হরফ বা লেটার বসিয়ে বসিয়ে ছাপার কাজ হতো। এটাকে বলা হতো লেটার প্রেস বা ট্রেডল মেশিন। প্রথম দিকে সেই সব মুদ্রনযন্ত্র বিদ্যুৎ ছাড়া পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে চালানো হতো। এরপর সেই সব মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোজন করা হয়। প্রথম দিকে সিস্টেম ছিল মেশিনের ভেতর হাত দিয়ে একটি কাগজ ঢুকানো হতো, মেশিনে চাপ খেয়ে কাগজটিতে লেখা ফুঁটে উঠার পর সেই কাগজ বের করা হতো। তারপর আরেকটি কাগজ বসানো হতো, তারপর আরেকটি-এইভাবে চলতো ছাপার কাজ।
কুষ্টিয়া জেলায় সর্ব প্রথম ট্রাডেল মেশিন বা লেটার প্রেসের প্রবর্তন করেন এ উপমহাদেশের সংবাদপত্রের পথিকৃৎ শ্রী হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। কুষ্টিয়া জেলার গড়াই তীরবর্তী কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়ায় অভাব অনটনের মাঝে অবহেলিত সমাজের বৈষম্য এবং জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলার জন্য ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার কুষ্টিয়ায় প্রথম মাসিক সংবাদপত্র ’গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন।

প্রথম দিকে হাতে লিখে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। পরবর্তীতে ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র্র বিদ্যারত্নের যন্ত্রে ’গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা। শেষের দিকে এক পয়সার সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।
নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে না পেলেও পত্রিকাটির প্রকাশনার জন্য ১৮৭৩ সালে কুমারখালী শহরের নিজ গ্রাম কুন্ডুপাড়ায় ’গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে লেটার প্রেসটি কিনে আনেন। দীর্ঘ ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী’র অর্থ আনুকূল্যে পত্রিকা চালানোর পর আর্থিক অনাটন ও সরকারের মুদ্রণ শাসন ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়ায় কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ঐতিহাসিক সেই ছাপার যন্ত্র, এমএন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পান্ডুলিপি আজও কালের স্মৃতি হয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর বোমা হামলায় কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ছাপাখানা ঘরের ছাদ ধবংস হয়ে গেলেও ছাপাখানাটি কোন রকমে রক্ষা পায়। বাড়ির এক কোণে আজো পড়ে আছে সেই প্রেসটি, যাতে রয়েছে কাঙাল হরিনাথ, লালন, মীর মশাররফ ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ। ‘বাংলা মদ্র্রণ যন্ত্র’ নামের যে যন্ত্রটিতে তিনি ১৮৭৩ সালে গ্রামবার্তা ছাপিয়ে ছিলেন, সেটি দর্শনার্থীদের জন্য এখনও তাঁর বাড়িতে রাখা আছে।
বাণিজ্যিক ভাবে কুষ্টিয়া জেলায় ব্রিটিশ শাসন আমলে দেবন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামের জনৈক ব্যক্তি কুষ্টিয়া শহরে প্রথম লেটার প্রেস বা ট্রাডেল মেশিন স্থাপন করেন। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে পাকিস্তান আমলে কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ায় আব্দুল বারী সুলভ প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে দেওয়ান প্রেস,ন্যাশনাল প্রেস,মুকুল মুদ্রণ,কল্লোল মুদ্রায়ণ, রহমান প্রেস, জিনাত প্রেস,ওয়েসিস প্রিন্টিংপ্রেস,টাউন প্রেস,লিয়াকত প্রেস,পপুলার প্রিন্টিং প্রেস, চৌধুরী প্রেস,জাগরণী মুদ্রাায়ন,বলাকা প্রেসসহ প্রায় ২০ থেকে ২৫ টি লেটার প্রেস গড়ে ওঠে। এসব প্রেস থেকে মূলত বই, পুস্তক, লিফলেট, লেভেল,ক্যাশ মেমো, বিয়ের কার্ড প্রভৃতি ছাপা হতো। পুরনো এসব প্রেসের মধ্যে বেশ কয়েকটি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
যারা এই ব্যবসায় টিকে রয়েছেন ৯০ দশকের পর থেকে তারা লেটার প্রেস ছেড়ে আধুনিক অফসেট প্রেসের সাথে যুক্ত হয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাইরে কুষ্টিয়া জেলায় একটি মাত্র লেটার প্রেস বা ট্রাডেল মেশিন কালের স্বাক্ষী হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কুষ্টিয়া শহরের কোর্টপাড়া এলাকায় কল্লোল মুদ্রায়ন নামের প্রেসটিতে একটি লেটার প্রেস বা ট্রাডেল মেশিন আজও কালের স্বাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে। প্রেসটির বর্তমান স্বত্ত্বাধিকারী মিঠু সাহা জানান, মূলত তাঁর বাবা কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মলিন কুমার সাহা প্রেস ব্যবসা দেখা শোনা করতেন। ৬৭-৬৮ সালের দিকে তিনি চায়নার তৈরি লেটার মেশিন দিয়ে প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। ৯০ দশক পর্যন্ত মেশিনটি সচল ছিল। পরবর্তীতে ব্যবসার প্রয়োজনে আধুনিক অফসেট মেশিন আনা হয়। লেটার প্রেস যুগের অবসান হয়। ২০২১ সালে মলিন কুমার সাহা পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লেটার প্রেসটি স্মৃতি হিসেবে প্রেসের এক কোনে সংরক্ষণ করে গেছেন। মিঠু সাহা আরো জানান, পিতার শেষ স্মৃতি হিসেবে তাঁরাও আজো প্রেসটি রেখে দিয়েছেন।
প্রবীন সাংবাদিক কুষ্টিয়ার প্রথম দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ বার্তা’র সম্পাদক ও অধুনালুপ্ত জাগরণী প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী আবদুর রশীদ চৌধুরী জানান, কুষ্টিয়া থেকে প্রায় ৫৬ বছর আগে তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক জাগরণী পত্রিকা প্রকাশিত হতো। যার প্রকাশনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর পর তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজী উইকলি রিভিউ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যার প্রকাশনার বয়স প্রায় ৪৫ বছর। পরবর্তীতে একই প্রেস থেকে তাঁর ভাই প্রয়াত ওয়ালিউল বারী চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইস্পাত পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। আর ১৯৮৭ সালে এই লেটার প্রেসেই আবদুর রশীদ চৌধুরীর সম্পাদনায় দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা প্রকাশিত হয়। আবদুর রশীদ চৌধুরী আরো জানান, সে সময় লেটার প্রেসে পত্রিকা বের করা ছিল চরম খাঁটুনির কাজ। একটা একটা করে অক্ষর টাইপ করে শব্দ তৈরি করতে হতো। এখনকার মত ছবি ছাপা যেত না। আগে থেকে কাঠের মধ্যে ব্লক তৈরি করে তার পর ছবি ছাপতে হতো।
কথা হয় লেটার প্রেস বা ট্রাডেল মেশিনে কাজ করা সেই সময়কার একজন কর্মী যিনি এখনো কল্লোল মুদ্রায়ন প্রেসে কর্মরত রয়েছেন সেই বিদেশ বাবু’র সাথে। তিনি জানান, তখন তাদের প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক মজুরি প্রদান করা হতো। সাপ্তাহিক মজুরি ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কে কত গেল টাইপ করেছেন সেই হিসেবে অনুযায়ী তাদেরকে মজুরি প্রদান করা হতো। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় লেটার প্রেস বা ট্রাডেল মেশিনে কাজ করা শ্রমিক আর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অধিকাংশ শ্রমিকই মৃত্যু বরণ করেছেন। দু-একজন যারা আছেন তারাও পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কুষ্টিয়া শহরের পদ্মা প্রিন্টিং প্রেসের মালিক শহিদুল ইসলাম জানান, লেটার প্রেসের শিশার তৈরি অক্ষর গুলো আসতো কলকাতা থেকে। সে সময় দুই ভাবেই লেটার মেশিন চালানো যেত। একটা পা দিয়ে। সেজন্য এটাকে ট্রেডল মেশিন বলা হতো। আবার বিদ্যুৎতের সাহায্যেও প্রেস চালানো যেত। ৯০ দশকের পর মুদ্রন শিল্পে আধুনিক অপসেট প্রেসের আর্বিভাব ঘটার পর এই লেটার মেশিন বা ট্রেডল মেশিনের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। সেই সময়ের ট্রাডেল মেশিনের মালিকরা তাঁদের ব্যবহৃত মেশিন গুলো লোহার দামে ভাংড়ী হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলায় কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের এমএন প্রেসের একটি এবং কল্লোল মুদ্রায়ন প্রেসে সংরক্ষিত লেটার প্রেসটিই কালের স্বাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//২ ফেব্রুয়ারী,২০২২//