মীর আনোয়ার হোসেন টুটুল, মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা:
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে।
অনিয়মই যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে মির্জাপুর শিক্ষা অফিস। থেমে নেই সিন্ডিকেট চক্র শিক্ষক নেতাদের দাপট। দীর্ঘ দিন ধরে চলছে শিক্ষা অফিসে অনিয়ম আর দুর্নীতি। নেতাদের এমন আচরনে ক্ষুব্দ প্রশাসেনর কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। শিক্ষা অফিসের নানা অনিয়ম ঠেকাতে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক তদন্ত কমিটি কাজ করছেন।
গত সোমবার টাঙ্গাইল জেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার (এডিপিও) মো. কফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি মির্জাপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে দুর্নীতির তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। তদন্তে এসে হয়রানীর শিক্ষার ভুক্তভোগি শিক্ষক, শিক্ষা অফিসার, সহকারী শিক্ষা অফিসার ও অফিসের কর্মচারীদের সাক্ষাত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। দুর্নীতি ও নিরীহ শিক্ষকদের হয়রানী বন্ধে মির্জাপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসের দুর্নীতিবাজ শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষক নেতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জেলা শিক্ষা অফিস জানিয়েছেন।
উপজেলার বিভিন্ন স্কুলের ভুক্তভোগি একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, দুর্নীতিবাজ শিক্ষক নেতাদের উপজেলা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আসা যাওয়ার দাপট থেমে নেই। ক্ষমতাধর ও দুর্নীতিবাজ সেই শিক্ষক নেতাগন বলে বেড়াচ্ছেন পত্রিকায় লেখালেখি হলেও আমাদের কেউ কিছু করতে পারবে না। শিক্ষা অফিস আমাদের। আমাদের হুকুমে চলবে। শিক্ষা অফিসের কিছু অসাধু অফিসারদের সঙ্গে রয়েছে এদের দহরম মহরম সম্পর্ক। স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসব দুর্নীতিবাজ শিক্ষক নেতাদের শিক্ষা অফিসে ঘোরা ঘুরিই যেন নিয়মে পরিত হয়েছে। এই সব দুর্নীবাজ শিক্ষক নেতাদের নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং রাজনৈতিক দলের নেতাগনও ক্ষুব্দ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা ও উপজেলা প্রশাসন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার কাজ করছেন। জেলা শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার মো. কফিল উদ্দিনকে। তার সঙ্গে রয়েছেন অপর কর্মকর্তা মাহবুব হোসেন। আজ সোমবার তদন্ত কমিটি হয়রানীর শিকার ভুক্তভোগি শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে অফিসার, কতিপয় শিক্ষক নেতা ও অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেটে করে চক্রটি নিয়োগ ও বদলী বাণিজ্যসহ অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে। এই চক্রের কবলে দীর্ঘ দিন ধরে অনিয়ম-দুর্নীতির কারনে উপজেলার ১৭০ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষক-কর্মচারী। সিন্ডিকেট চক্রটি শিক্ষকদের জিম্মি করে জন প্রতি ৩০০০-৪০০০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার পরও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ৬০ জন সহকারী শিক্ষক ডিপিএড প্রশিক্ষণের বকেয়া বেতন পাচ্ছে না সাত বছর। একজন শিক্ষকের বকেয়া বেতনের পরিমান প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা। আবার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ২০০শ শিক্ষকের বেতনন গত দুই মাস বন্ধ হয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ ছাড়া মির্জাপুর উপজেলা প্রাথমিক অফিসে কোন কাজ হয় না। সব কিছুর মুলে রয়েছে ৪-৫ জন অঘোষিত শিক্ষক নেতা। এই চক্রের হাতে অফিস পুরোপুরি জিম্মি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগি অর্ধশত অভিযাগ করেন, বিভিন্ন উন্নয়ন মুলক কাজের জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা সরকারী ভাবে বরাদ্ধ আসে মির্জাপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে। এই শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে শিক্ষা অফিসের দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। চক্রটির চাহিদা মত টাকা না দিলে অসহায় শিক্ষকদের দিনের পর দিন হয়রানী করা হচ্ছে। পুকুর চুরির মত ঘটনা ঘটছে এই শিক্ষা অফিসে। ১০-১২ জন সিনিয়র শিক্ষকদের নাম বাদ দিয়ে বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে জুনিয়র শিক্ষকদের নামের তালিকা পাঠিয়ে তাদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর সবই কলকাঠি নেড়েছেন সেই ৪-৫ জন শিক্ষক নেতা। এনিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবী জানিয়েছেন।
চক্রটির খুঁটির জোর এতই বেশী যে, তাদের ইশারায় চলে শিক্ষা অফিস। বিভিন্ন বই, ছাড়পত্র, প্রশংসাপত্রসহ ডায়রী-১ ও ডায়রী-২ নামে বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাজারে যার দাম ৭০০-৮০০শ টাকা। সেই ডায়রী কিনতে হচ্ছে ১৮০০শ-২০০০ হাজার টাকায়। হাতিয়ে নিচ্ছে রাখ লাখ টাকা। এদিকে উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার জন্য ২০১৫-২০১৬ শিক্ষা বর্ষ থেকে ২০১৯-২০২০ সালে ৬০ জন শিক্ষক পিটিআইতে দেড় বছর মেয়াদী ডিপিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পরও এই সিন্ডিকেটের কারনে গত সাত বছরেও ৬০ জন শিক্ষক বকেয়া বেতন পাচ্ছে না। শিক্ষা অফিস এই চক্রের কারসাজির কারনে গত দুই মাস ধরে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রায় ২০০শ শিক্ষকের বেতন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকায় রিপোর্ট আসার পর থলেল বিড়াল বের হতে শুরু করেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ডিপিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকসহ বিভিন্ন সমস্যার কারনে যাদের বেতন বন্ধ ছিল হিসাব রক্ষণ অফিসের মাধ্যমে তাদের একাউন্টে টাকা জমা হচ্ছে। কোন শিক্ষক যাতে অফিসে হয়রানীর শিকার না হন সে জন্য আন্তরিকতার সাথে কাজ করা হয়। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবী করেন। কোন শিক্ষক নেতা অফিসের কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি করতে না পারে সে জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান ও জেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার (এডিপিও) মো. কফিল উদ্দিন বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে যারা দোষী প্রমানিত হবে আইনগত ভাবেই তাদরে বিরুদ্ধে ব্যবস্তা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিও) সুব্রত কুমার বণিক বলেন, মির্জাপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নানা অনিয়ম হয় বলে তিনি অভিযোগ পেয়েছেন। সাধারন শিক্ষক যেন কোন ভাবে হয়রানীর শিকার না হন সে জন্য নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। শিক্ষা অফিসের নাম ভাঙ্গিয়ে কোন শিক্ষক নেতা যাতে কোন অপকর্ম করতে না পারে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//

Discussion about this post