Print Date & Time : 9 June 2025 Monday 3:31 am

মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-সন্তান হারানো জোহুরা বেগমের শেষ নিবেদন

স্বামী ও মেয়ের কি পরিনতি হয়েছিল তা সে জানেনা। ৫১ বছর অপেক্ষার পরও ফিরে আসেনি তার স্বামী ও মেয়ে। পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সাজুর মতো রূপাই রূপি স্বামীর জন্য কান পেতে আজও অপেক্ষার নিশি পার করেন বয়োবৃদ্ধা জোহুরা বেগম।

আশিতিপর এই বৃদ্ধার নাম জোহুরা বেগম। সে সাতক্ষিরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের মহন্দীর নিভৃত পল্লীর বাসিন্দা। তার স্বামী আব্দুল সরদার ছিলেন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকসেনাদের হাতে তার স্বামী মেয়ে ও ছেলে প্রাণ হারিয়ে শহীদ হয়েছেন। ৫১ বছরেও তারা পায়নি আত্ম উৎসর্গের স্বীকৃতি।   

১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বামী ও সন্তান হারা হতভাগা জোহুরা বেগম দেশতথ্য প্রতিবেদকের কাছে কান্না মেশানো গলায় যুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছে এই অপরাধে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীরা পরিবারের সদস্যদের প্রতি নির্যাতন করেছে। বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এরপর নিরুপায় হয়ে ছেলে আজগর, রহমত  মেয়ে আছিয়া, রশিদা, সুফিয়া ও সাহিদাকে নিয়ে ভারতে চলে যায়। সেখানকার শরনার্থী শিবিরে অবস্থান নেই। এর কিছু দিন পর খবর পায় স্বামী আব্দুল সরদার পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েছেন।

এই খবর শুনে তড়ি-ঘড়ি করে সন্তানদের নিয়ে বেনাপোল বন্দর হয়ে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। পথি মধ্যে পাকসেনারা কিশোরী মেয়ে সুফিয়াকে ছিনিয়ে নেয়। বোনকে বাঁচাতে গিয়ে মেঝ ছেলে আজগর পাকসেনাদের গুলিতে আহত হয়। তাকে নিয়ে যখন আমরা ব্যাস্ত তখন সুফিয়াকে নিয়ে হায়েনারা চলে যায়। তারপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তোবা তাদের পাশবিক নির্যাতনে এক সময় সেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালা উপজেলা শাখার কমান্ডার মোঃ মফিজ উদ্দীন বলেন, আলী আহমদ, আব্দুল সরদার, মুনতাজসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধকালীণ সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। এরপর তাদেরকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর বয়স বিবেচনায় মুনতাজকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্মম নির্যাতন শেষে আব্দুল সরদারকে অন্যদের সাথে খুলনার গল্লামারী নিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, তালা উপজেলা শাখার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার এবং তালার বীর মুক্তিযোদ্ধা অমলকান্তি ঘোষ জানান, ১৯৭১ সালে আব্দুল সরদারসহ অন্যরা বসিরহাটের টাকী ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং শেষে তারা ৬/৭ জন বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন।

আব্দুল সরদারের মেঝ ছেলে আজগর সরদার জানান, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তারা জানতে পারেন, অন্যদের সাথে তার পিতাকে পাকিস্তানি আর্মিরা যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর নির্মম নির্যাতন শেষে অন্যদের সাথে খুলনার গল্লামারী নিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। তবে তখনো খবরটি তাদের কাছে পৌছায়নি।

আব্দুল সরদারের নাতনী পাইকগাছার কাশিমনগর গ্রামের ইসহাক আলী মোড়লের মেয়ে লিলিমা খাতুন বলেন, শৈশব থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে তার নানা, খালা-মামাদের উপর ঘটে যাওয়া নির্মম কাহিনী শুনতে শুনতেই তিনি বড় হয়েছেন। গল্প শুনে যুদ্ধকালীণ ঘটনার বর্ণনাই তার মুখস্ত হয়ে গেছে। নানী, মা, মামা-খালাদের পাশাপাশি তারও দাবি, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথায় তার নানা ও খালার নাম দু’টিও যুক্ত হোক।

আব্দুল সরদারের মেঝ ছেলে ভান চালক আজগর সরদার বলেন, তিনি যুদ্ধ করেননি,তবে গর্বের সাথে বীরের ছেলে বলে নিজেকে দাবি করেন। সেদিন দেশে ফেরার পথে পাকিদের হাত থেকে নিজের বোনকে বাঁচাতে নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

জোহুরা বেগম বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কেউ তার স্বামী সন্তানের খোঁজ খোঁজ দেয়নি। স্বাধীন দেশের সরকার জনপ্রতিনিধি কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের কেউ নেয়নি তার কোন খোঁজ।

স্বামী ও মেয়ের কি পরিনতি হয়েছিল তা সে জানেনা। তারপরও তাদের অপেক্ষায় কেটে গেছে ৫১ টি বছর। ফিরে আসেনি তার স্বামী ও মেয়ে। বয়োবৃদ্ধা জোহুরা বেগম পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সাজুর মতো রূপাই রূপি স্বামীর জন্য কান পেতে আজও অপেক্ষার নিশি পার করেন।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় কেবল শৈশব-কৈশর কিংবা দাম্পত্য সর্বোপরী যুদ্ধকালীন লোমহর্ষক মর্মান্তিক বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়ে বয়োবৃদ্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পত্নির সময় কাটে। নির্মম বিয়োগান্তক ঘটনার জীবন্ত স্বাক্ষী জোহুরা বেগমের করুণ আর্তি, তার স্বামী আব্দুল সরদার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।  তার মেয়ে সুফিয়া দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি টুকু দেওয়া হোক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো জোহুরা বেগমের নিবেদন বিবেচনায় না নিলে হয়তো কেউ জোহরার কাছে গিয়ে শুনাবে সেই শিহরণ জাগানো গান “ হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না, বিজয়ী বীর মুক্তি সেনা তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না না- না-না—–”  

আর//দৈনিক দেশতথ্য//১৫ জুন-২০২২//