Print Date & Time : 16 May 2025 Friday 3:14 am

.-:মুক্তির কড়চা:-

দ্বিতীয় পর্ব

বাবার চাকুরী সূত্রে কাবেরীদের পরিবার  কুমিল্লা শহরে। মমতাজ বেগম কুমিল্লা মহিলা কলেজের ভিপি। মমতাজ আপা সম্পর্কে নানা গল্প শুনেছে কাবেরী। সে বিপ্লবী নেত্রী। ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারনে সরকার তাকে ইডেন কলেজ থেকে বহিস্কার করে পরীক্ষা দিতে দেয়নি। একজন নারীর এত সাহসের কথা শুনে নিজের অজান্তেই মমতাজ বেগমের ভক্ত হয়ে উঠলো কাবেরী। মনে  খুব ইচ্ছে হলো মমতাজ আপার সঙ্গে সে পরিচিত হবে। কি ভাবে মমতাজ আপার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়? এত বড় সাহসী কতই না দুর্ধর্ষ তিনি, যদি আবার বকা দেয়,অপমান করে, নানা কথা  ভাবে সে। মহল্লার একটি মেয়ের সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে কাবেরীর। ওরা এক সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করে। সাথী নামের ওই মেয়েটি কাবেরীর চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়ে। তবুও খুব ভাব তাদের ,ন্ধুর মত আচরণ । সাথীর এক ফুফাতো ভাই আফজাল খান তখোন কুমিল্লা শহরে নামকরা ছাত্রনেতা। শেখ মুজিবের দল করে। সাথীর বাবাও মুসলিম লীগ ছেড়ে শেখ সাবের ভক্ত হয়ে উঠেছেন। আফজাল খানকে মাঝে মাঝে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সাথীর বাবা উকিল, তিনি কোট থেকে আফজাল খানকে ছাড়িয়ে আনেন। মাঝে মাঝে মমতাজ আপাকে নিয়ে সাথীও জেল গেটে গিয়ে আফজাল খানকে ফুলের মালা দেয়। সাথী সে সব গল্প শোনায় কাবেরীকে । মমতাজ আপার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছের কথা একদিন সাথীকে জানায় কাবেরী। এর মধ্যে কলেজে নির্বাচন হবে বলে গুঞ্জন শোনা গেল। কাবেরী বেশ উৎফুল্ল। সে কলেজে ভোট দিতে পারবে। কি আনন্দ! বেশ মজা হবে। বাড়িতে খাবার টেবিলে-মা-বাবাকে বললো, আমাদের কলেজে ভোট হবে। আমরা ভোট দেবো। এক অন্যরকম আবেগ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কাবেরীকে সে ভোট দিতে পারবে। কাবেরীর মা বলে উঠলো, ভোট হবে ভালো আবার নিজে নির্বাচনে দাড়িঁয়ে যেও না। কাবেরীর বাবা হাসে, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে দাড়াঁলে দোষ কি? তোমার মেয়ে নেত্রী হবে? কর্কশ কণ্ঠে কাবেরীর মা জবাব দেয়, শোনো মেয়েকে কিন্ত তুমি খুব অস্কারা দিচ্ছো? এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষন হাসি-ঠাট্টা চলে। কাবেরী পড়ার টেবিলে যায়। স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে কাবেরীর বাবা বলে শোন, আমার মেয়ে অবিবেচক মেয়ে নয়। নিজের বুদ্ধিতে ও যা করার করবে। মেয়ের প্রতি আমার ভরসা আছে। আড়াল থেকে সব শুনে কাবেরী।

সে দিন রোববার কলেজ বন্ধ। কাবেরী ও সাথীদের বাসা পাশাপাশি। দুপুরের পর কাবেরী যায় সাথীদের বাসায়। সাথী জানায় তুমি এসে ভালো করেছো। আজ মমতাজ আপা আসবেন আমাদের বাসায়। কলেজে নির্বাচন, মমতাজ আপা ভিপি পদে নির্বাচন করবেন। আমাকেও নাকি কোন এক পদে দাড়াঁতে হবে। আফজাল ভাই বলে দিয়েছেন। মমতাজ আপা আসবেন বাবার সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নেওয়ার জন্য। মমতাজ আপার সঙ্গে আসবেন ছাত্রলীগের আরেকজন নেতা সৈয়দ রেজাউর রহমান। কিছুক্ষন পরেই তারা এসে পড়লেন। সাথী মমতাজ আপা ও সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে কাবেরীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ওর নাম কাবেরী, আমাদের কলেজের ছাত্রী। ওর বাবা পুলিশ আফিসার। আনুষ্ঠানিক পরিচয় হলো মমতাজ আপার সঙ্গে। এরপর কলেজে গেলেই কথা হতো। মমতাজ আপা খুজেঁ বের করতেন কাবেরীকে। এক সময়ে দু’জন বেশ ঘনিষ্ট হয়ে উঠলো। কাবেরী ছাত্রলীগের রাজনীতি করে না, মিছিলে যায় না তবে দারুনভাবে রাজনীতি সচেতন। দেশের খোজঁ খবর রাখে। হোক নারী বা পুরুষ পৃথিবীতে কিছু মানুষকে দেখলে আপন আপন মনে হয়। নিজের স্বজন মনে হয় তেমনি একজন কাবেরী মিত্র। আবার কিছু লোককে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন খুবই দুর্ভেদ্য চরিত্র দিয়ে যাকে কখনোই আপন ভাব যায় না।

   কাবেরীর খুব জানতে ইচ্ছে করে কি ভাবে মমতাজ আপা  এত বড় নেত্রী হয়ে উঠলেন। কেনই বা রাজনীতি করতে আসলেন। তাও আবার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবের রাজনীতি, এত কঠিন বিষয়। পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে হওয়ার কারনে মাঝে মাঝে বাবার কাছ থেকে কাবেরী জানতে পারে-আইয়ুব খানের সরকার শেখ মুজিবের ওপর কি পরিমান ক্ষ্যাপা। একবার কাবেরীর বাবার ওপর নির্দেশ এসেছিলো শেখ মুজিব কুমিল্লা মিটিং করতে আসলেই তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এসপি সাহেব বাবাকে ডেকে নিয়ে অর্ডার দিয়েছিলেন। বাবা বাসায় খাবার টেবিলে সে কথা বলেছিলেন। সে দিন বাবার খুব মন খারাপ দেখেছি। বাবা বলেছিলেন, এসপি সাহেব এ কাজটা আমাকে দিয়েই করাতে চান। পুলিশে তো আরো লোক আছে, কিন্ত এসপি বেছে নিলেন আমাকে। কাবেরী সে দিন বাবাকে প্রশ্ন করেছিলো, বাবা এতে সমস্যা কি তুমি তো কত লোককেই গ্রেপ্তার করো। বাবা খুব গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, মা একমাত্র ওই লোকটাই তো বাঙ্গালীদের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু করছেন। বাকী নেতারা তো কেউ সরকারের দালাল আবার কেউ বিভ্রান্ত আবার অনেকের সত্য বলার সাহস নেই, নিজেদের সততাও নেই। শেখ মুজিব সৎ ও সাহসী নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাতে পেরেছেন। সে জন্য দিনে দিনে দ্যাখো দেশের বিশেষ করে যুব সমাজ তার দিকে ঝুকেছে। একদিন এই যুব সমাজই তো দেশের নেতৃত্ব দেবে ।

    মাওলানা ভাসানীর  প্রতি দেশের মানুষের ভরসা ছিলো। উনি কি কাজটা করে ফেললেন, দেশের মানুষ যখন আইয়ুব খানের যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ। সে সময়ে ভাসানী সাহেব বললেন,‘ডন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব।’ আমি ভাসানী ভক্ত মানুষ, তবে তার এ কথায় খুব কষ্ঠ পেয়েছি। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের এখন পড়ন্ত বেলা। আশা ভরসা ছিলো মাওলানা

আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে, এখন তিনিও দেখছি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছেন। তা হলে বাঙ্গালীদের ভবিষ্যত কি? শেখ মুজিব এখনো বয়েসে তরুন। তাকে ঠেকিয়ে রাখতে নানা পদের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কথা বললেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে দিন পত্রিকায় দেখলাম মোনায়েম খান বলেছেন, ৬ দফা দাবী থেকে সরে না আসলে শেখ মুজিবকে কারাগারেই থাকতে হবে। সে কখনো সুর্যের আলো দেখতে পাবে না।’ এটা কোন কথা হলো। লোকটা কি পাগল নাকি? দেশের একজন সিভিল নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্র কি এমন ভাষায় কথা বলতে পারে?  মেজাজ খারাপ করেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন ফনি ভূষন মিত্র। রাতে বাসায় ফিরে কাবেরীর বাবা বললেন,যাক এবারের মত বাচাঁ গেছে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে হয়নি।  নারায়নগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় আসার পথেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এবি//দৈনিক দেশতথ্য//১৬.০২.২০২২//