(পূর্ব প্রকাশের পর)
ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা সেরে অরিত্রর জন্য নাস্তা প্যাকেট করে নিয়ে রিক্সায় উঠলো। হল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বেশী দূরে নয়। দ্রুতই পৌছে গেল হাসপাতালের সামনে। তার মনে পড়লো অরিত্র ঘন ঘন চা খায়, নেশা বলতে ওর চা আর সিগারেট। ধুমপান নিয়ে আমাদের দেশে মেয়েদের খুব নাকসিটকানী আছে, অনেকে একদম সিগারেটের ধুয়া সহ্য করতে পারে না। আবার অনেকে সিগারেট নিয়ে একটু বেশীই নেতিবাচক ভাব দেখায়। কাবেরীর মনে পড়লো তাদের ক্লাসের বন্ধু আজাদের কথা। ইতিহাসের ছাত্রী বিপাশার সঙ্গে ওর এ্যাপেয়ার ছিলো। আজাদ ঘন ঘন সিগারেট খায়, বিপাশা সিগারেটের গন্ধ একদম পছন্দ করে না। শেষ পর্যন্ত সিগারেট নিয়ে তাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল। কাবেরীর অবশ্য সিগারেট নিয়ে তেমন কিছু ভাবে না, কারো সিগারেটের নেশা থাকলে করবে, এতে তার আপত্তি নেই। বরং তার মনে হয় সিগারেট খেলে আর গোপ রাখলে বরং পুরুষ মানুষদের পুরুষের মতই মনে হয়। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে হবে কেনো। হাসপাতালে তো চা দেয় না, তা হলে কি করা যায়? কাবেরী চিন্তা করলো বরং ছোটখাটো একটা ফ্লাক্স কিনে ফেলি, পরেও তো এটা কাজে লাগবে। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় হলে চা পান করা যাবে। রিক্সাওয়ালাকে বললো ভাই একটু নাজিমউদ্দিন রোডে চলুন। নাজিমউদ্দিন রোডে একটি দোকানে সে ফ্লাক্স দেখেছিলো। মমতাজ আপার সঙ্গে পুরান ঢাকার দীন নাথ সেন লেনে যাওয়ার সময়ে একদিন সে দোকান তার চোখে পড়ে। নাজিমউদ্দিন রোডে গিয়ে পয়ত্রিশ টাকা দিয়ে একটি ক্লাস্ক কিনলো। হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে ফ্লাস্কভর্তি চা এবং হল থেকে আনা নাস্তা নিয়ে কেবিনে গেল। হল থেকে বেরুনোর সময়ে কয়েকদিন আগে কেনা সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা সিরিজের দু’টি বই সঙ্গে করে নিয়ে গেল। কাবেরী জানে রহস্য উপন্যাস এবং গেরিলা যুদ্ধের ওপর বই পড়া অরিত্রর নেশা। হাসপাতালে যদি আরো কিছু দিন থাকতে হয়, তা হলে ও বই পড়ে সময় কাটাতে পারবে। সেবা প্রকাশনীর বই দু’টি তারা একসঙ্গে গিয়ে কিনেছিলো। বই কেনার পর বই দু’টি কাবেরীর কাছে রেখে পল্টনে মিটিং এ গিয়েছিলো অরিত্র। কাবেরী এ ক’দিনে বইগুলো পড়ে শেষ করেছে। কাবেরীরও খুব বই পড়ার নেশা। তাদের বাড়িতে দেশ পত্রিকা রাখা হয়,সত্যজিত রায়ের লেখার খুব ভক্ত তার বাবা। কাবেরীর মায়েরও বই পড়ার নেশা।
অরিত্রর ঘুম ভেঙ্গে গেছে মাঝ রাতে। ব্যাথা তেমন নেই। শরীরটা বেশ ঝরঝরা মনে হচ্ছে। বারবার তার মনে পড়ছিলো কাবেরীর আজ ওর প্রতি আলাদা একটি টান অনুভব করছে। এতদিনে এটা হয়নি। তবে কাবেরী সব সময় ওর রাজনীতিকে সমর্থন করে। সেও ভাবে দেশটা স্বাধীন হলে ভালো হতো। দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা একটা মানসিক নির্যাতনের মধ্যে আছে। একই দেশে বসবাস করে হিন্দুরা যেন দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক। যদিও কাবেরী নিজেকে কখনো সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবে না, বাঙ্গালী হিসেবে ভাবে। কাবেরীর নানা সময়ের কথা-বার্তায় অরিত্র এমন ধারনা করেছে। তবে সে মেলাতে পারছে না কাবেরী সেদিন মিছিলে গেল কি ভাবে? আগের দিন সে জানতে চেয়েছিলো তবে কাবেরী কোন জবাব দেয়নি। আজ কাবেরী আসলে, সে আবারো সে জানতে চাইবে। আবার ভাবে আজ কি সে আসবে? মার খেয়েও অরিত্র ভেঙ্গে পড়েনি, আইয়ূব খানের ওপর তার রাগ আরো বেড়েছে। ভাবছে কবে পশ্চিমরা বিদায় হবে, কবে দেশটা আমাদের হবে। মুজিব ভাইকে ওরা গ্রেপ্তার করেছে, শুনছি তার নামে এবার রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দেবে। তা হলে কি ওরা মুজিব ভাইকে ফাসিঁ দিয়ে দেবে? এমন নানা চিন্তা করতে করতে রাত পোহালো। বিছানা থেকে নেমে কিছুক্ষন হাটাহাটি করলো। তবে টের পায় হাটতে গেলে মাথাটা ঘুরে। আবার বিছানায় যায়, বসে পড়ে।
কাবেরীর হাতে নাস্তা, চায়ের ফ্লাস্ক দেখে অবাক হলো অরিত্র। ফ্লাস্ক পেলে কোথায়? নাজিমউদ্দিন রোড থেকে কিনে আনলাম। তুমি ঘন ঘন চা খাও তাই। তবে সিগারেট কিন্ত আনিনি, এটা হাসপাতাল, এখানে ধুমপান নিষেধ বলে মৃদু হাসলো কাবেরী। হাসপাতালের দেওয়া প্লেট ধুয়ে নাস্তা দিলো। আবার নীচে গিয়ে এক গ্লাস গরম পানি এনে হরলিকস করে দিলো। নাস্তা শেষে চা। ব্যাগ থেকে বই দু’টি বের করে দিলো। নাস্তা খাওয়ার সময়ে একটু রসিকতা করলো কাবেরী এটা কিন্ত রোকেয়া হলের নাস্তা। এমনি তো খেতে পারতে না, পুলিশের অছিলায় তবু রোকেয়া হলের নাস্তা খেতে পারলে। এ নিয়ে দু’জনে বেশ হাসাহাসি করলো। অরিত্রর মনটা হালকা করার জন্য কাবেরী ইচ্ছে করে রসিকতা করছিলো। দু’জনের মনটা আজ একটু ফুরফুরে। ঘন্টা খানেক ধরে ওরা নানা গল্প করে সময় কাটালো। এর মধ্যে ছাত্রলীগের এক কর্মী ইত্তেফাক পত্রিকা নিয়ে কেবিনে আসলো। পত্রিকার প্রথম পাতা জুড়ে অরিত্রকে মারধর করার সেই ছবি। ছবির নীচে ক্যাপসন। ছাত্রলীগ নেতা অরিত্র জামানের ওপর পুলিশের বর্বরোচিত হামলা। দ্রুত পত্রিকাটি হাতে নিলো কাবেরী, অরিত্রর বিছানায় বসে দু’জনে মিলে ছবিটা দেখলো। খবরটা পড়লো। কাবেরী হাসতে হাসতে বললো যাক ভাগ্য ভালো তোমাকে রিক্সায় নিয়ে আসার সময়ের ছবিটা ছাপেনি। তা হলে তো মা আজই ঢাকায় এসে আমাকে কুমিল্লায় নিয়ে বন্দি করতো।
ইত্তেফাকের নিউজ এডিটর সিরাজউদ্দিন হোসেনের সঙ্গে অরিত্র খুব ভালো সম্পর্ক। মাঝে মাঝে টিকাটুলীর মোড়ে ইত্তেফাক অফিসে যায় সে। সিরাজউদ্দিন হোসেনের কাছে গল্প শুনে। দেশটা কি ভাবে পাকিস্তানীদের কবল থেকে মুক্ত করা যায়, তা নিয়ে সিরাজউদ্দিন হোসেন আলোচনা করেন। তিনি শুধু সাংবাদিকই নন, মুজিব ভাইর ভক্ত। কলকাতায় থাকতে মুজিব ভাইর সঙ্গে তার পরিচয়। দু’জনে একসঙ্গে রাজনীতি করতেন। ঢাকায় এসে সিরাজউদ্দিন হোসেন রাজনীতি না করে সাংবাদিক হলেন। আওয়ামী মুসলীম প্রতিষ্ঠার পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভাবলেন দলের একটি পত্রিকা থাকা দরকার। সে জন্য মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও মুজিব ভাই মিলে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক বের করলেন। পত্রিকার দায়িত্ব দেওয়া হলো তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া ও মোতাহার হোসেন সিদ্দিকীকে। ইত্তেফাক প্রকাশের সময়ে বেশ কিছু অর্থকড়ি দিয়ে সহায়াতা করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। অরিত্র ইত্তেফাকের নিয়মিত পাঠক। ইত্তেফাক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সাহস করে লিখে। বিশেষ করে ছয় দফা নিয়ে বিশ্লেষনমূলক লেখা লিখে। অরিত্রের কাছে ইত্তেফাক পত্রিকা হলো বাঙ্গালীদের ঠিকানা। সে কারনেই একদিন ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে গিয়ে সিরাজউদ্দিন হোসেনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আসলে সে গিয়েছিলো মানিক মিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে, পত্রিকা অফিসে গিয়ে শুনে মানিক মিয়া সাহেব কারাগারে। আইয়ূব খানের সরকার তাকে রাষ্ট্রের জন্য বিপদজ্জক ব্যাক্তি হিসেবে উল্লেখ করে গ্রেপ্তার করেছে।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//২১ ফেব্রুয়ারী//২০২২//
(পরবর্তী অংশ পাবেন আগামী কালের সংখ্যায়)