তৃতীয় পর্ব :
রিক্সা থেকে নেমে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দোতলায় অরিত্রর কেবিনে গেল কাবেরী। নুরুল ইসলাম ঠান্ডু ভাই বসে আছেন। অরিত্র তখনো ঘুমাচ্ছে। একটি হরলিক্সের বয়ম নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলেন, ফজলুল হক মনি। অরিত্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিছু সময় পর আসম আবদুর রব আসলেন। আরো কয়েকজন ছাত্রনেতা আসলেন। আরো কয়েকটি কেবিনে ছাত্রলীগের আহত নেতাকর্মীরা আছেন। অনেকেরই ক্ষত হয়েছে। মাথায় সেলাই লেগেছে। কারো কারো পা ভেঙ্গে গেছে। নেতাদের রুমে দেখে বেশ লজ্জা পাচ্ছিলো কাবেরী। তার ভেতরে প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো নেতারা যদি তার পরিচয় জানতে চায়, তা হলে কি জবাব দেবে। কিছুক্ষনের মধ্যে কেবিন ভরে গেল, নেতাকর্মীরা একের পর এক কেবিনে আসছে অরিত্রকে দেখতে। ভীড়ের মধ্যে সুযোগ করে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো সে। দাড়িঁয়ে রইলো বারান্দায় বেলকনিতে হেলান দিয়ে। ঘন্টাখানেক পর আসলেন মমতাজ আপা। কাবেরীকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মমতাজ আপা বললেন, কি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেনো। চলো ভেতরে যাই, না আপা কেবিনে অনেক লোক। তাতে কি হয়েছে, চলো যাই। মমতাজ আপার সঙ্গে কেবিনে গেল কাবেরী। মমতাজ আপা নেতাদের সঙ্গে কাবেরীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, কাবেরী আমাদের কর্মী, ওর আরেকটি পরিচয় আছে, মায়ের দিক থেকে সে কুমিল্লার ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের নিকট আত্মীয়, সম্পর্কে তার নাতি। ও আবার অরিত্রর ক্লাসমেট। একে একে নেতারা বের হয়ে গেলেন। কিছু সময় অবস্থান করে মমতাজ আপা গেলেন অন্য কেবিনে আহত নেতাকর্মীদের দেখতে। কাবেরী দাঁড়িয়ে আছে, অরিত্রর পাশে। খুব ইচ্ছে করছে ওর কাপালে একটু হাত বুলিয়ে দিতে, আবার সংকোচও হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে লজ্জাও পাচ্ছে। তখোনো অরিত্রর ঘুম ভাঙ্গেনী। কেবিনে আর কেউ নেই। লজ্জা সংকোচ ঝেড়ে কাবেরী হাত রাখলো অরিত্রর কপালে। অরিত্র চোখ মেলে তাকালো, বললো কাবেরী তুমি হলে যাও নি। কাবেরী জানতে চাইলো, তুমি এখন কেমন আছো। ব্যাথা কমেছে? শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসলো অরিত্র। হ্যা এখন অনেক ভালো লাগাছে। তেমন ব্যাথা অনুভব করছি না। এর মধ্যে ডাক্তার এলেন কেবিনে, সঙ্গে একজন নার্স। ডাক্তার বললেন উঠে বসেছেন কেনো, শুয়ে থাকুন। কিছু ব্যাথার ওষুধ দিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন, বললেন তেমন সমস্যা নেই, তবে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। ডাক্তার নার্সকে বলে গেলেন, ওষুধগুলো ভরা পেটে খাওয়াতে হবে। কাবেরী জানে অরিত্র সারাদিন কিছু খায়নি। কাবেরী বললো, তুমি থাকো, আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি। আধা ঘন্টা পর শুকনো কিছু খাবার নিয়ে আসলো কাবেরী। সেগুলো একশ্বাসে খেয়ে নিলো অরিত্র। আবার নীচে গিয়ে ক্যান্টিন থেকে গরম পানি এনে এক গ্লাস হরলিকক্স করে দিলো। নার্সকে ডেকে নিয়ে আসলো ওষুধ খাওয়ানোর জন্য। নার্স কাবেরীকে জিজ্ঞেস করলো রোগী আপনার কি হয়? কাবেরী কোন জবাব দিলো না, কোন কথা বললো না অরিত্রও। নার্স আবারো জানতে চাইলো? লজ্জায় কাবেরী তখোন আড়ষ্ঠ, এবারো নার্সের জিজ্ঞাসার কোন জবাব দিলো না। ওষুধগুলো খাইয়ে দিয়ে নার্স চলে গেল। অরিত্র বললো কাবেরী বসো, না এখন যেতে হবে, হলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে। বকুনি খেতে হবে, এখন তো সামান্য দেরি হলেই নোটিশ ধরিয়ে দেয়, আবার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায়ও নোটিশ পাঠায়। তুমি ঘুমাও , আমি আসি বলে অরিত্রর কপালে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে আসলো কাবেরী।
দরজায় এসে ফিরে তাকালো অরিত্রর দিকে। সেও তাকিয়ে আছে। যদিও কাবেরীকে বলেছে এখন ব্যাথ্যা নেই ভালো আছে, আসলে এটা ছিলো কাবেরীরকে দেখানো, তার কাছে সাহসের প্রমান দেওয়া। কাবেরী চলে যাওয়ার সময়ে তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করলো অরিত্র কিন্ত পারলো না, সারা শরীর ব্যাথ্যা। ব্যাপারটা খেয়াল করলো কাবেরী, আসলে মেয়েদের কাছে মিথ্যা বলে লাভ হয় না, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক কিছুই বেশী অনুধাবন করতে পারে। কাবেরী চলে আসলো ঠিকই তবে মনটা কেবিনেই থাকলো, খুব খারাপ লাগছিলো তার, এমন ব্যাথ্যা নিয়ে সারারাত একাএকা কি ভাবে থাকবে। এখানে তো ওর আপন বলতে কেউ নেই। বাড়ির লোকেরা কেউ খবরও পায়নি। যদি বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, কি ভাবে যাবে। এমন নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে হলে আসলো। অনেক রাত অবধি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করলো, ঘুম আসে না। যদিও মাঝে মাঝে সে ভাবতে চায়, আরো অনেকেই তো অরিত্রর মত আহত হয়েছে, তবে সে শুধু একা অরিত্র জন্য ভাবছে কেনো। ওর সাথে তো বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। তা হলে ওর জন্য মনটা কাদঁছে কেনো। আবার ভাবে না, ঠিকই তো আছে অরিত্র দেশের জন্য লড়াই করছে, দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য মার খাচ্ছে, এ মন কাঁদা তো শুধু অরিত্রর জন্য নয়, ওর লড়াইর জন্য দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য ওর ভেতরে যে আগুন জ্বলছে তার প্রতি যা ভালোবাসা সেটা তো ওর ভেতরের আগুনের জন্য। না, না ওপর প্রতি ভালোবাসা ঠিকই আছে। অন্য যারা আহত হয়েছে মার খেয়েছে, তাদের জন্যও তো সমবেদনা আছে, এখন অন্যদের সঙ্গে তো অরিত্রর মত পরিচয় নেই। অরিত্র তার ক্লাসমেট, মানে বন্ধু। শেষ রাতের দিকে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো কাবেরী। হাসপাতালে যেতে হবে, মনে হলো অনেক বেলা হয়ে গেছে। বিছানা থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো। বালিশের নীচে রাখা ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে দেখলো না, মাত্র ছ’টা বাজে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো, রুমের অন্যরা তখেনো জাগেনি। আজ রোববার বিশ্বদ্যিালয় বন্ধ। এ দিন সবাই একটু বেশী বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। ক্লাসে যাওয়ার তাড়া থাকে না। কেউ কেউ এ দিন জামা কাপড় পরিস্কার করে। আবার অনেকে বিকেলে বের হয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। দলীয় কর্মসূচী থাকলে অনেকে মিছিলে যায়।
কাবেরী গোসল সেরে, কালো পাড়ের একটি সাদা শাড়ি পরে বেরুলো। ——-
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//২০ ফেব্রুয়ারী//২০২২
(পরবর্তী অংশ আগামী কাল )

Discussion about this post