পঞ্চম পর্ব:
সাত দিন হাসপাতালে থেকে বেরুলো অরিত্র। এখন সুস্থ। সাত দিনেই কখনো সকাল,কখনো বিকেলে হাসপাতালে গিয়েছে কাবেরী। অরিত্র সলিমউল্লাহ মুসলিম হলে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র। কাবেরী ভর্তি হয়েছিলো সমাজ বিজ্ঞানে,পরে পরিবর্তন করে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এসেছে। রাষ্ট্র বিজ্ঞান তার ভালো লাগে। রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক ছাত্র আবদুর রাজ্জাক,একই বিভাগের বড় ভাই হিসেবে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই খুব আন্তরিকতা হয়ে যায় অরিত্রর। এরপর নিয়মিত যোগাযোগ। এছাড়া অরিত্র ফরিদপুরের ছেলে,আবদুর রাজ্জাকের বাড়িও ফরিদপুরে। আবদুর রাজ্জাক সে সময়ে দিনের একটি সময় বিশেষ করে বিকেল বেলা কাটাতেন পুরান ঢাকার জগন্নাথ কলেজের পশ্চিম পাশে ‘রুচিয়া’ নামে একটি ক্লাবে। রুচিয়া রেষ্ঠুণ্ঠের মালিক ছদরুল নামের একজন আদি ঢাকাইয়া। পুরান ঢাকার উঠতি বয়েসের এবং ঢাকাইয়া সরদারের ছেলেরা রুচিয়াতে আড্ডা দেয়।
মাজেদ সরদারের বাড়ি নাজিরা বাজার। তার ছেলে নাজির হোসেন রুচিয়ার নিয়মিত আড্ডাবাজদের একজন। আড্ডার মাঝে নাজির হোসেন প্রস্তাব দেয়,আমরা রুচিয়া নামে একটি ক্লাব করলে কেমন হয়। ক্লাবের মাধ্যমে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা হবে,কুস্তির আয়োজন করা যাবে,শাকারাইন উৎসব পালন করতে পারবো,এ নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যাবে। নাজির হোসেনের এ প্রস্তাবকে প্রথম সমর্থন দিলো কাদের সরদারের ছেলে। অন্যরা সবাই একবাক্যে রাজী হয়ে গেল। হয়ে গেল রুচিয়া ক্লাব। রুচিয়া ক্লাব হয়ে উঠলো আদি ঢাকাইয়াদের প্রাণের ঠিকানা। শুধু খেলাধুলাই হয়না,সামজিক নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে এরা। টুকটাক বিচার সালিশও হয়। ঢাকার ১১ সরদারদের কেউ ক্লাবের বিরোধীতা করে না বরং আরো উৎসাহ দেয়। কাদের সরদার বলেন, আরে মিয়া পোলাইনগো বি কিছু শেখোনোর দরকার আছে,আমরা আর কয়দিন আছি,ওরাই তো এলাকা বি চালাইবো,ক্লাব কইরা বি ভালাই করছে।’
অরিত্রর এক বন্ধু আরমানিটোলায় এক বাসায় পড়ায়। তার কাছ থেকে অরিত্র পুরান ঢাকার কালচার সম্পর্কে জানে,তাদের উর্দু এবং বাংলার মিশেলে অদ্ভুত এক ধরনের ভাষা শুনে হাসে। বন্ধু মিহির হাওলাদারের কাছ থেকে শুনেছে,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ কলেজের অনেক ছাত্র পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাড়িতে লজিং মাষ্টার থেকে পড়াশোনা করে। এদের বাড়িতে মেয়েদের জন্য আলাদা হুজুর রাখা হয়,মেয়েদের বাংলা পড়ানো হয় না,তারা শুধু আরবী শেখে,কোরান শরীফ পড়তে পারাই তাদের পড়াশোনা,শিক্ষা। যদিও এখন কিছু পরিবার সে প্রথা ভেঙ্গেছে তারা মেয়েদের স্কুলে দিয়েছে।
হল থেকে বেরিয়ে অনেকটা অজানার উদ্দেশ্যে হাটছে অরিত্র। কোথায় যাওয়া যায় হাটতে হাটতে ভাবছে। পড়ন্ত বিকেল,ভাবলো টিএসসিতে যাই। হঠাৎ রাস্তার ওপাশ থেকে তার নাম ধরে কেউ যেন ডাকলো,তাকিয়ে দেখে রিক্সায় বসে আছেন আবদুর রাজ্জাক। চলো, রুচিয়া ক্লাবে যাই। অরিত্র কিছু না বলেই রিক্সায় উঠে বসলো। রিক্সা চলছে পুরান ঢাকার দিকে। অরিত্রর ভেতরে বেশ কৌতুহল,রাজ্জাক ভাই কেন রুচিয়া ক্লাবে যায়,ওটা তো আদি ঢাকাইয়াদের ক্লাব। রাজ্জাক ভাই তো ফরিদপুরের লোক। তিনি লজিং মাষ্টারও থাকেন না। রাজনীতির কারনে গেলে তো জগন্নাত কলেজে যাবেন,কিন্ত রুচিয়া ক্লাবে কেনো? বিষয়টি চেপে না রেখে সে সরাসরি রাজ্জাক ভাইর কাছে জানতে চাইলেন? আবদুর রাজ্জাকের রুচিয়া ক্লাবের যাওয়ার নেপথ্য কাহিনী শুনে তো অবাক অরিত্র,তার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল,ভাবলো আসলেই মুজিব ভাই দুরদর্শী নেতা।
ঢাকার রাজনীতি বলতে গেলে পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। কয়েক বছর হলো পুরান ঢাকা শব্দটি যোগ হয়েছে,নতুন ঢাকা সবে শুরু। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় জমজমাট হতে শুরু করেছে,তবে রাজনীতি জগন্নাথ কলেজ কেন্দ্রিকই রয়ে গেছে। আবদুর রাজ্জাক বললেন,শোনো অরিত্র,ঢাকার রাজনীতি মানেই পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার লোকদের, বিশেষ করে পুরান ঢাকার সরদারদের সমর্থন না পেলে রাজনীতি করা বেশ কঠিন। মুজিব ভাই সে জন্য পুরান ঢাকার সরদারদের সঙ্গে সুস্পর্ক রাখেন। মুজিব ভাই আমাকে বলেছেন,পুরান ঢাকার যুবকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ছাত্রলীগকে শক্তশালী করতে পারিনি। এনএসএফ এর গুন্ডাদের দাপট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের অনেক সমর্থক আছে,তবে গুন্ডাদের ভয়ে তারা এগিয়ে আসার সাহস করে না। আরেকটু সময় লাগবে। এখন জগন্নাথ কলেজে আমাদের সমর্থন বেশী। এটা পুরান ঢাকার ভেতরে। পুরান ঢাকার সরদার এবং যুব সমাজকে আমাদের পক্ষে না রাখতে পারলে জগন্নাথ কলেজেও আমারা ঠিকতে পারবো না। ঢাকার সব সরদার হয় তো আমাদের সঙ্গে থাকবেন না,আমাদের সমর্থন দেবেন না,তবে সম্পর্কটা থাকলে আমাদের বিরোধীতা করবেন না। রুচিয়া ক্লাব চালায় মূলত ঢাকাইয়া সরদারদের ছেলে-পেলে ও আÍীয় স্বজনেরা। ওরা আমাদের পক্ষে থাকলে সরদাররাও আমাদের প্রতি নরম থাকবে। সে কারনে রুচিয়া ক্লাবে যাই। কুস্তিগীরি করি,এটা তো আসলে দেখানো। ভেতরের বিষয়টি হলো,ওদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। ঢাকাইয়া সরদারদের মধ্যে কাদের সরদার বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন। মাজেদ সরদার নবাব বাড়ির নির্দেশ মেনে চলে। আমিও রুচিয়া ক্লাব ওভাবে চিনতাম না,আমাকে চিনিয়ে দিয়েছেন সিরাজুল আলম খান। এ নিয়ে একদিন আমি ও সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করি,মুজিব ভাই আমাকে বলেন,তুই ওখানে ভর্তি হয়ে যা। সেই থেকে আমি রুচিয়া ক্লাবে আসি। এখন এদের অনেকের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। একটা কথা শুনে রাখ আদি ঢাকাইয়ারা কিন্ত সহজ-সরল,এদের মধ্যে প্যাচ কম,তোমাকে একবার ভালো বাসলে বেঈমানী করবে না। এতদিন এদের সঙ্গে মিশে আমি বুঝেছি। সময় পেলে মাঝে মাঝে আসবি আমার সঙ্গে। ওদের সঙ্গে পরিচয় হবে,সম্পর্ক হবে। এটা কাজে লাগবে। রাজনীতি করতে হলে পুরান ঢাকার অলি-গলি চেনার দরকার আছে। বর্তমানে কিন্ত পুরান ঢাকার নীচের দিকে এলাকা মানে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেষে কিন্ত আমাদের ফরিদপুরের মাদারীপুর,পালং,গোসাইরহাট এলাকার অনেক লোক এসে ঘরবাড়ি করে থাকতে শুরু করেছে। ওরা এখনো ঢাকাইয়া সরদারদের ভয়ে আমাদের পক্ষে মুখ খুলে না,আমরা সংগঠনটা একটু শক্ত করতে পারলে কিন্ত ওরা আমাদের পাশ এসে দাড়াঁবে। অরিত্র সে সন্ধ্যায়ই প্রথম রুচিয়া ক্লাবে পরিচিত হলো। নাজির হোসেন বসা ছিলেন ক্লাবে,আবদুর রাজ্জাক অরিত্রকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন,ইনি মাজেদ সরদার সাহেবের ছেলে। নাজির হোসেন ক্লাবের পিয়নকে ডেকে বললেন,আরে মিয়া কই বি থাকো মেহমান আইছে চা খিলাও”
(ষষ্ঠ পর্ব পড়বেন আগামীকাল)

Discussion about this post