-হাসান টুটুল : বছর কয়েক আগে সাময়িক অবকাশ যাপনে ভারতে গিয়েছিলাম বেড়াতে। তখন চলছিল, বসন্তোৎসবের চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা। ট্রেনে-বাসে, শহরের রাজপথে, ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে সর্বত্রই দেখি, বিশাল কালার-পেপারে অয়েল প্যাষ্টেলে আঁকা ছবি সহ প্রখ্যাত কমেডিয়ান লাজবন্তীর বিজ্ঞাপনের জয়যাত্রা। সেবার মফঃস্বল এলাকার সড়ক পথের একধারে একটি বিশাল বটবৃক্ষের নীচে ব্যাঙের ছাতার মতো বিরাটাকারে তাবু গেঢ়ে বসেছিল, পুতুলনাচ, চিড়িয়াখানা ও কিছু ঐতিহাসিক চিত্রকলার লাইট শো-এর প্রদর্শনী। সেই সঙ্গে চলছিল, জনপ্রিয় রসালো হাস্যকৌতূকে ভরপুর বহুরূপী লাজবন্তীর গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য এবং টক্-শো। ডেইলি তিনটে করে শো। প্রতিটি শো তিনঘন্টা করে। নাচে-গানে আর একক অভিনয়ের এক আনন্দময় অভিনবত্বের পসরা নিয়েই লাজবন্তীর নিরন্তর পদযাত্রা। ননষ্টপ টানা তিনঘন্টা আত্মমুগ্ধতায় মেলার মিলনায়তনের উন্মত্ত দর্শক শ্রোতাদের চুম্বকের মতো আবিষ্ট করে রেখেছিল, বহুরূপী লাজবন্তীর অনবদ্য রসালো উপস্থাপনার মাধ্যমে। সেই সঙ্গে মঞ্চে লাজবন্তীর বিচরণ ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং আনন্দদায়ক। নিদারুণ অঙ্গ ভঙ্গিমার মাধুর্যে নারী চরিত্রের বাস্তব রূপ এবং তার নৃত্যকলা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সমস্ত দর্শক শ্রোতাদের হৃদয়ে যে প্রচন্ড রেখাপাত করেছিল, তা নিঃসন্দেহ। কথায় কথায় সাবলীলভাবে তার বাংলা, হিন্দি, উর্দু বলার বাকচাতুর্য, কখনো নৃত্যগীতের অপূর্ব মূর্ছনা, কখনো ভূতের মতো জমকালো বিচিত্র পোশাকে আর্বিভাব হয়ে পলকেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া শুধু বিস্মিতই নয়, অত্যন্ত চমকৃতভাবে সমস্ত দর্শক-শ্রোতাদের দৃষ্টি আর্কষণ করেছিল তার কলা-কাব্যের নিখুঁত পরিবেশনায়।
কিন্তু পর্দার অন্তরালে তাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্মন্ধে আমাদের কখনো কোনো ভাবান্তর হয়না। হবার কথাও নয়। নিতান্ত প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকেরই দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে অন্ন-বস্ত্রের মতো মানসিক খোরাক মিটাতে ক্ষণিকের সঞ্চিত যে আনন্দটুকু আমরা পাই, শুধুমাত্র সেটুকুই চিরতরে রয়ে যায় আমাদের অদৃশ্য এক অনুভূতিতে। কিংবা গেঁথে থাকে অম্লান স্মৃতির পাতায়।
মানুষ্য জীবন বড় বিচিত্র। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ কি না করে! যখন ভাগ্যের পরিহাসে নির্দয় নিষ্ঠুরের মতো স্বয়ং বিধাতাই মানুষের সুখ শান্তি ও আনন্দময় জীবন কেড়ে নিয়ে মানুষকে বিকলাঙ্গ করে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। যেমন কমেডিয়ান লাজবন্তী, যার জন্ম লগ্নে বাকশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছেন বিধাতা। দৃষ্টিশক্তিও কম, স্পষ্ট দেখতে পারে না চোখে। যার ফলে প্রাথমিক বিদ্যাটুকু অর্জন করবার মতো ক্ষমতা তার ছিলনা। তবু জীবনের বহু জটিলতা থেকে খানিকটা মুক্ত হয়ে শুধু চেয়েছিল, কারো গলদঘর্ম না হয়ে, অধিকতর উন্নতমানের জীবন ও উন্নত চিন্তা-ভাবনার চেয়ে পৃথিবীতে নূন্যতম ও নির্ভেজালভাবেই বেঁচে থাকতে। কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় প্রতিদিন টক্-শো ও নৃত্যনাট্যের একটানা ন’ঘন্টা কি কঠিন বাস্তবতার সংঘাতে কবলিত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে তাকে যে বাঁচতে হতো, কেইবা রাখে তার সে খবর!
সেদিন দূপুর থেকেই গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। একটু হাওয়া নেই, বাতাস নেই। পশু-পক্ষীর কলরব নেই। যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবীটা। কিন্তু মানুষ তো আর থেমে নেই। রুজি-রোজগারের অন্বেষণে সকলেই ধাবিত, উদ্যত। নদীর স্রোতের মতো চলছে অবিশ্রান্ত। তন্মধ্যে কেউ কেউ আসন্ন ঝড়-বৃষ্টির বিরূপ চিত্র অনুমান করেই সেদিনকার প্রদর্শনী বন্ধ রেখেছিল। একমাত্র চালু ছিল লাজবন্তীর টক্-শো। যেদিন ছিল তার শো-এর শেষ দিন। যা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি লাজবন্তী।
সেদিন লাজবন্তীর একক নাট্যাভিনয়ের একটি দৃশ্য প্রতিবিম্বের মতো তার মুখমন্ডলে বাস্তব ঘটনার স্বরূপ চিত্র এতোটাই ফুটে উঠেছিল যে, মোহাবিষ্ট দর্শকমন্ডলীর জোরালো করতালির পরমুহূর্তেই অত্যাশ্চর্যজনকভাবেই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। যার পূর্বাভাষ ক্ষণপূর্বেও বোধগম্য হয়নি। যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
অভিনয় চলাকালীন নাট্যমঞ্চে হঠাৎ কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যেতেই থমকে দাঁড়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাজবন্তী। ওর চোখেমুখে তখন উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। গলা টেনে গ্রীণরুমের দিকে পলকমাত্র দৃষ্টি হেনেই ভয়ার্ত চোখে দর্শকের দিকে তাকিয়ে থাকে। হতভম্ব সকল দর্শকবৃন্দও তখন স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। কেউ কেউ চিৎকার করে ওঠে। -“কি হলো রে ভাই! নাটক বন্ধ হয়ে গেল কেন?”
আরেকজন পিছন থেকে ফিক্ করে হেসে বলে,-“এই রেঃ, বেচারা ডায়লগ্ই ভুলে গিয়েছে বোধ হয়!”
কিন্তু তখন যে ওর বিপন্ন সময়ে চরম সমস্যার জট ক্রমশই পাকিয়ে যাচ্ছিল, তা কে জানতো! কে জানতো, হতভাগ্য লাজবন্তীর ভাগ্যবিড়ম্বনার কথা! ওর নির্মম পরিহাসের কথা! যার যাযাবরের মতো জীবন, নিজস্ব থাকা খাওয়া ও নির্দিষ্ট সংস্থানের কোনো নিশ্চয়তাই নেই! ঘুরে বেড়ায় দেশে-বিদেশে। রাত কাটায় শহরের পথেঘাটে, নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে।
ক্ষণিকের বিভ্রান্তিকর ও বিরূপ পরিস্থিতির কবলে পড়ে অপ্রস্তুত লাজবন্তী ভয়ে-সন্ত্রস্তে র্থর্থ করে কাঁপতে শুরু করে। অপারগতা ও অক্ষমতার কারণে অপরাধীর মতো ওর চোখেমুখে বিভীষিকা আর আকুতি। অথচ চমকপ্রদ রমণী অবয়বে পায়ে ঘুঙ্ঘুর আর কাঁখে কলসী নিয়ে ক্ষণপূর্বে যাকে গ্রাম্যবধূর বেশে অত্যন্ত সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যভাবে নৃত্য পরিবেশন করতে দেখেছিলাম, সে যে মাঝবয়সী একজন সুঠাম, সুদর্শন সুপুরুষ, তা বোঝারই উপায় ছিল না।
ইতিপূর্বে দর্শকের হৈ-হট্টোগোলে লাজবন্তী মঞ্চ ছেড়ে দ্রুত ছুটে যায় গ্রীণরুমে। ততক্ষণে সব শেষ! স্বাভাবিক কারণে আমরা দর্শকরাও কৌতূহল দমন করতে পারিনি। ওর পিছে পিছে গিয়ে ঢুকে পড়ি গ্রীণরুমে। কিন্তু ঢুকেই থ্ হয়ে যাই বিস্ময়ে। এক ধরণের বেদনানুভূতিতে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ পাকিয়ে দেখি, সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। রীতিমতো মর্মান্তিক এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
নেপথ্যে প্রি দিতে দিতে হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে লাজবন্তীর (ওরফে কালিচরণ দাস) বিকলাঙ্গ স্ত্রী ম্যানকা। কি হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য! মুখ থুবড়ে হুইলচেয়ারেই উপুর হয়ে পড়ে আছে ম্যানকা। মুখ দিয়ে গলগল করে ফ্যানা পড়ছে। তখনও ওর হাতে ধরা ছিল স্ক্রীপ্টের কাগজটা।
আচমকা বিপদগ্রস্থ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাজবন্তী বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে তার সদ্য মৃতা স্ত্রী ম্যানকার বিবর্ণ মুখের দিকে। অশ্রুকণায় চোখদুটো চিক্চিক্ করে উঠতেই শিশির বিন্দুর মতো টপটপ করে অঝোর ধারায় বইতে লাগল। চলে গেল লাজবন্তীর জীবনসাথী। জীবনের শেষ সম্বল। থেমে গেল লাজবন্তীর প্রেম নদীর খেয়া। নিভে গেল ওর আশার প্রদীপ। ভেঙ্গে গেল দীর্ঘ দিনের প্রতিষ্ঠিত অভিনীত জীবনের রঙ্গমঞ্চ, লাজবন্তীর খেলাঘর। এখন ও’ বাঁচবে কাকে নিয়ে, কি নিয়ে! বিদায়বেলায় কিছুই তো বলে যেতে পারল না ম্যানকা। কত শখ্ ছিল ওর! শাড়ি নয়, গহনা নয়, শুধুমাত্র একটি মুক্তার নোলক। ক’দিন আগেই স্বামীর কাছে আবদার করে চেয়েছিল, একটি মুক্তার নোলক। নাকে পড়বে। লাজবন্তীও সাবেগে মাথা নেড়ে ওকে কথা দিয়েছিল, পরিয়ে দেবে। কিন্তু ম্যানকার শেষ ইচ্ছাটুকু যে পূরণ করতে পারল না লাজবন্তী! ওর প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাত-কাপড় ছাড়া জীবনে কিইবা দিয়েছে, দিতে পেরেছে! মৌলিক চাহিদা মেটাতেই কতনা হিমশিম খেতে হয়েছে! কি হবে লাজবন্তীর ভবিষ্যৎ, কোথায় ওর গন্তব্য! অথচ তখনও কানে বাজছিল, ক্ষণপূর্বের কোলাহল মুখর চমকপ্রদ বাদ্যযন্ত্রের শব্দ-তরঙ্গের সেই শ্রুতিমধুর সুর ও ছন্দের ঐক্যতান, প্রাচীন লোকসঙ্গীতের এক নিদারুণ অপূর্ব মূর্ছণা! রয়ে গেল চাঞ্চল্যকর সেই তারুণ্যের উচ্ছলতা, সজীবতা আর আনন্দময়তার রেশ।
হঠাৎ দুইহাতে বুক চাপড়ে হাউ মাউ করে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ে স্ত্রীর শোকে কাতর মুহ্যমান কালিচরণ ওরয়ে লাজবন্তুী। যাকে সান্তনা দেবার মতো সেদিন কেউ ছিলনা ওর পাশে।
কন্তু মানুষের জীবন নদীর প্রবাহ সদা চঞ্চল ও বহমান। কখনো একই স্থানে থেমে থাকেনা। রোদ-বৃষ্টি -ঝড়-তুফান উপেক্ষা করেই অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে আমরণ এগিয়ে চলে আপন ঠিকানায়, তার নিজস্ব গন্তব্যে। নতুন দিগন্তে নতুন সূর্য ওঠা একটি সুন্দর ভোরের আশায়।
ঠিক তেমনিই জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রখ্যাত কমেডিয়ান লাজবন্তী ভাগ্যবিড়ম্বনায় বিপন্ন জীবনের সংঘাতে অবিশ্রান্ত জীবন নদীর স্রোতের টানে সে যে কোন মোহনায় গিয়ে আঁটকে আছে, কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে, তা কে জানে!

Discussion about this post