সীমান্ত হত্যা ভারত এবং বাংলাদেশের সুসম্পর্কর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। ১৮ বছরে আড়াই হাজার লোক সীমান্তে নিহত হয়েছেন। এই ইস্যুটি দু’দেশের গর্ভমেন্ট টু গর্ভেন্টই নয়, পাবলিক টু পাবলিক রিলেশন ধরেও টানাটানি শুরু করেছে। ফেলানী হত্যার পর এটা এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুও বটে।
বাংলাদেশী নিহত হলে এই নিষ্ঠুরতার দায় উঠে ভারতের বিএসএফ’র কাঁধে। আর ভারতীয় নিহত হলে বদনাম যায় বিজির মাথায়। সীমান্তে যারা আছেন তারা সবাই জানেন এই ঘটনার জন্য কারা মূলত: দায়ী। কিন্তু সেকথা কেউ বলেননা। না বলার কারনও কিন্তু আছে।
সেই কারনটি কী তা জানতে দৈনিক দেশতথ্য অনলাইন মিডিয়া ভর করেছিল লালমনিরহাট সংবাদদাতার উপর। লালমনিরহাট সংবাদদাতা সুদিপ্ত শাহীন কয়েকদিন খেটে একটি প্রতিবেদন দেশতথ্যের ঢাকা অফিসে পাঠিয়েছেন।
সাংবাদিক সুদীপ্ত শাহীন প্রতিবেদনে বলেছেন, লালমনিরহাটে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বর্ডার এরিয়া আছে। এর সব জাগাতেই যে কিলিং হয় তা কিন্তু নয়। কিলিং হয় সেখানে, যেখানে গরু স্মাগলিং রেশিও বেশি। চলতি মাসের ৯ নভেম্বর/২২ তিনি গিয়েছিলেন আদিত্যমারীর ভেলাবাড়ি সীমান্তে।
২ নভেম্বর/২২ বুধবার ভোরে এই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দু’জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। তাদের একজনের নাম ওয়াসকুরুনী (৩২)। সে ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের মহিষতুলি গ্রামের সানোয়ার হোসেনের ছেলে। অপরজন একই ইউনিয়নের ঝাড়িরঝাড় গ্রামের সাদেক আলীর ছেলে আয়নাল হক (৩০)।

এই দুই জনের মৃত্যু নিয়ে ডিটি প্রতিবেদক সীমান্তের মানুষের সাথে কথা বলেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, নিহত দুই জনই গরুপাচারকারী। সীমান্তে নিয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে থাকা একজন সংবাদ কর্মী জানান, বুধবারে নিহত ওই দুইজন গরু পাচারকারী জমতুলি গ্রামের জমশের মেম্বারের কোটার সদস্য।
”কোটার সদস্য” ? মানে কি ? কোটা আবার কি? এ প্রশ্ন অবান্তর নয়। ওই সাংবাদিক জানিয়েছেন, কোটা মানে সংঘবদ্ধ গরু পাচারকারী দল। এরা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় বাঁশের চরকী বসিয়ে গরু পার করে আনে। এই গ্রুপকে স্থানীয়রা কোটা বলে। একটি কোটায় ৩০/৩৫ জন চোরাকারবারী থাকে। এই এলাকায় ১৬ টি কোটা আছে। এই ১৬ টি কোটা দুইজন নিয়ন্ত্রণ করেন।

কোটা দিয়ে একটি গরু পার হলে বিজির নামে এজেন্টের পকেটে যায় ২২ হাজার টাকা। এক ঘন্টা সুযোগ দেওয়ার জন্য বিএসএফ এর এজেন্ট নেয় ৩/৪ লক্ষ টাকা। একটি গরু পার করতে লাগে প্রায় ১/২ মিনিট। এই হিসেবে ঘন্টায় গরু আসে গড়ে প্রায় ৪০/৪৫ টি। ভারতীয় কোটাবাজদের গরু প্রতি দিতে হয় ১০/১২ হাজার টাকা। ১০+২২=৩২ হাজার টাকায় একটি গরু বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে এসব গরুর গড় মূল্য প্রায় ৬০/৭০ হাজার টাকারও উপরে। অর্থাৎ গরুর কারবারে দ্বিগুণ লাভ।
এই লাভই কোটাবাজদের বেপরোয়া করে তোলে। আর এসব কাজ চলে রাত ১টার পর থেকে। তাই বেশিরভাগ কিলিং রাতেই হয়।
কোটাবাজদের জন্য বিজিবি বা পুলিশ কোন সমস্যা নয়। সমস্যা হলো বিএসএফ। বিএসএফ এর সাথে কন্ট্রাক করে ইন্ডিয়ান পার্টের কোটাবাজরা। তারা বেশিরভাগ সময় বিএসএফকে টাকা না দিয়েই বেড়ায় চরকী লাগায়। অনেক সময় চরকী না বসিয়ে কাঁটা তারের বেড়া কাটে। বিএসএফ এর টহল পার্টির সামনে পড়লে তারা বাধা দেয়। কোটাবাজরা বাধা উপেক্ষা করে বিএসএফকে আক্রমণ করে বসে। আবার কিছু কিছু বিএসএফ সদস্য অভ্যাসগত ভাবেও হিংস্র। এমন পরিস্থিতিতে হত্যাকাণ্ড গুলো ঘটে। বিএসএফ এর সাথে কন্ট্রাক ঠিক থাকলে তারা দুরে বসে গরু পার করার দৃশ্য উপভোগ করে।
লোহাখুচি জিরো পয়েন্টের অদুরে জনৈক জব্বারের বাড়ি (ছদ্দ নাম)। এই জব্বার সীমান্তের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানিয়েছেন, লোহাখুচি বর্ডারে এমন ১৬টি গ্রুপ আছে। ১৬টি কোটার নেতৃত্বে রয়েছেন দুইজন। এদের একজনের নাম শফিকুল ইসলাম মিন্টু। সে গোড়ল ইউপির ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার। অপর জন গোড়ল ইউপির সেবক দাশ গ্রামের ইদ্রিস আলীর পুত্র আনোয়ার হোসেন। এই দুই জনের নেতৃত্বে গরু পাচারকারী দলের চৌকি বা কোটা নিয়ন্ত্রণ হয়।
নানা বিষয়ে নিয়ে তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে বিরোধ বাধে। এসব বিরোধ মিমাংশা করে দেয় পুলিশ। গোড়ল ইউনিয়নের ভারতীয় গরু পাচারকারী চক্রের হোতা শফিকুল ও আনোয়ারের মধ্যে কিছুদিন আগে বিরোধ লাগে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, গত ৬ নভেম্বর কালীগঞ্জ থানার ওসি গোলাম রসূল ওই দুই জনের মধ্যে মিমাংসা করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ৮টি কোটা শফিকুল এবং অপর ৮টি আনোয়ার নিয়ন্ত্রণ করবেন।
কোটার প্রধানরা বর্ডার গার্ডের বিওপি ক্যাম্প ও পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য তারা টাকা ব্যবহার করে। এতেও ম্যানেজ না হলে তাদের অন্য ব্যবস্থাও আছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, যে দেবতা যে ফুলে খুশী হয় তাদের জন্য সেই ব্যবস্থাও তারা করে দেয়। এই জন্য এই এলাকায় যৌন কর্মীদেরও ব্যবসা একেবারে খারাপ নয়।
একটি সূত্র বলছে, বর্তমান ও সাবেক কিছু বিজিবির কর্মকর্তা লালমনিরহাট সীমান্তের প্রায় ১৫ শত কোটি টাকার গরু পাচারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা বিগত শীতের মৌসুমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ১টি চিঠি ইস্যু করিয়েছিলেন।
সেই চিঠিতে মাত্র তিন মাসের জন্য খন্ডকালীণ গরু পাচারের খাটালের অনুমোদন দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির আওতায় গোরকমন্ডলে এই খাটাল স্থাপন করার জায়গা নির্ধারণ হয়। এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে এই চিঠি দেয়া হয়েছিল। চিঠির ১টি কপি এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। লারমনিরহাট সীমান্তে আইন শৃংখলার অবনতির আশংকায় গোয়েন্দারা গরু পাচারের বা গরুর খাটালের বিরোধীতা করে।
লালমনিরহাট জেলা সদরের কুলাঘট চরে ১টি আন্তর্জাতিক চক্র আছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে গাঁজা, ফেন্সিডিল ও মহিষের চোরাকারবারী করে।
স্থানীয় সূত্র আরো জানিয়েছে, বিজিবির উর্ধতন এক কর্মকর্তার বাড়ি রংপুরে। তার ভাগিনা মামার জোরে সীমান্ত ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করে আসছেন। এই ভাগিনার কারসাজিতে ১৫ বিজিবির জন্য ১১৮ টি ভারতীয় হিরো সাইকেল কেনা হয়েছিল। কুলাঘাট ষ্ট্রীলের সেতু ও বিশেষ ক্যাম্প তার নিয়ন্ত্রণে চলে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, গত দুই/তিন সপ্তাহ আগে ভারতীয় ৬০ লাখ রুপি ও দুই লাখ মার্কিন ডলার দৈই খাওয়া ও কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছিল। এ সময় নৈশকোচ হতে সেই রুপি ও ডলার খোয়া যায়। এ নিয়ে দুই দেশের হুন্ডি ব্যবসায়িদের মধ্যে শুরু হয় বসচা। সেই কারণে প্রায় ২/৩ সপ্তাহ ধরে সীমান্তে মাফিয়াদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজিত ছিল। এর প্রভাবে বেশ কিছুদিন ধরে লালমনিরহাট সীমান্তের প্রায় দুই শত কিলোমিটার জুড়ে মাদকসহ সকল চোরাচালানি বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিএসএফ এর নির্দয়তা সম্পকে যতটা শুনা যায় বাস্তবতা তেমন নয়। বিএসএফ সীমান্তের সাধারণ মানুষের সাথে যতটা আন্তরিক বিজিবি তার উল্টো। বিকেলের দিকে বিএসএফের মহিলা সদস্যরা টহলে থাকে। তারা সীমান্তের কাজ করা নারী পুরুষের সাথে খুবই আন্তরিক।
বিজিবি বিওপি ক্যাম্পের সাথে সাধারণ মানুষের কোন সখ্যতা বা যোগাযোগ নেই। তবে মাদক ব্যবসায়ি, চোরা কারবারি, গরু ও মানব পাচারকারির সাথে ঠিকই তাদের যোগাযোগ রয়েছে। সীমান্তে অবৈধ ব্যবসার প্রতিবাদ করলে চোরাকারবারিরা বিজিবির অসৎদের দিয়ে স্থানীয়দের হয়রানি করে থাকে। এই অভিযোগ করেছেন লোহাখুচি বর্ডারের কৃষক রোস্তম আলী (৬০)।
সীমান্তবাসীরা আরো বলেন, বিজিবির ক”জন মিলে বাইসাইকেলে এক ঘন্টা টহল দিয়ে বিওপিতে ফিরে যায়। এভাবে সকাল ১০টা, ১২ টা, ৩ টা ও বিকাল ৫ টায় টহল দেয়। তারপর দায়িত্ব শেষ। রাতে কোন কোন দিন টহল বের হয় কখনো বের হয়না। হাটের দিন সীমান্তবর্তী হাট গুলোতে লোক দেখানো টহল দিতে দেখা যায়।

এব্যাপারে বিজিবির একটি সূত্র বলছে, সীমান্তে টহলের জন্য বিএসএফ এর যে অবকাঠামোগত যে সুবিধা আছে বিজিবির তা নেই। যেমন কাঁটা তারের বেড়া ঘেঁষে তাদের রয়েছে পাকা রাস্তা। বিজিবির টহলের জন্য এমন অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। যার ফলে টহলে বিএএফ এর মতো সুবিধা বিজিবির নেই।
লোহাখুচি বর্ডার এলাকার কৃষক আব্দুল্ল্যাহ (৫৫)। মিজানুর রহমান(৫৭) ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল একজন সীমান্ত সাংবাদিক বলেছেন, সীমান্তে আইনের কঠোরতা নিরপেক্ষ নয়। যার ফলে সীমান্ত অপরাধী, হুন্ডি ব্যবসায়ি ও চোরাকারবারীদের কঠোর হস্তে দমন করা যায়না। সীমান্তের প্রতিটি হত্যাকান্ডের পর সংবাদ কর্মীরা দায়সারা গোছের রির্পোট করে। থানা পুলিশ লাশ মর্গে প্রেরণ এবং থানায় ইউডি মামলা রুজু করে দায়িত্ব সারে। বিজিবি ১টি প্রেসরিলিজ সংবাদ কর্মীদের হাতে দিয়ে দায়িত্ব সারে।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ চান সীমান্ত গ্রামবাসী। তারা রাতে সার্বক্ষণিক নিচ্ছিদ্র পাহারাও চান। যদি এটা করা যায় তবে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব। এসব কথা গুলো বলেছেন,
তারা বলছেন, বেশিরভাগ কিলিং হয় রাতে। দিনের বেলায় নোম্যন্স ল্যান্ডে কাজ কর্ম করতে গিয়ে উভয় দেশের কোন নাগরিক নিহত হয়েছেন এমন ঘটনা শোনা যায়নি বললেই চলে। এমন খবর কোন মিডিয়াতেও আসেনি।
আবার সব দোষ বিজিবির আর ভারতীয় বিএসএফ যে, ধোয়া তুলশী পাতা তা নয়। তাদের মধ্যেও আছেন দূর্নীতিবাজ। তারা সীমান্ত মাফিয়াদের হয়ে কাজ করেন। দুই দিকের দুই দুর্নীতিবাজ গ্রুফ যখন হরিহর হন তখন কোন অঘটন ঘটেনা। যখন এর বিপরীত কিছু ঘটে তখনই তৈরী হয় খবরের উপাদান।
একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তের প্রতিটি গ্রামের মানুষ শান্তি চায়। তারা রাত্রিকালীণ পাহারার ব্যবস্থা চালু করতে আগ্রহী। তাদের কাজে লাগালে সীমান্তের গরু পাচার চক্র নিষ্ক্রিয় হতে বাধ্য। বিজিবি নির্লোভ হয়ে যদি উদয়াস্থ টহলের ব্যবস্থা করে তাহলে সীমান্তে চরকী বসানো সম্ভব হবে না। এর এটা করতে পারলে সীমান্ত হত্যা শূণ্যে আনা সম্ভব।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//নভেম্বর ১৩,২০২২//

Discussion about this post