রফিকুল্লাহ্ কালবী, কুষ্টিয়া : ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি দেখা যাচ্ছে- যা ‘টেগর লজ’ নামেও সমধিক সুপরিচিত। এটি কুষ্টিয়ার মিলপাড়ায় কবি আজিজুর রহমান সড়কে মোহিনী মিলের উত্তর দিকে অবস্থিত। আজ এই ভবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরবো।
কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি বা টেগর লজের কথা বলার আগে একটু অন্য কথা বলে নিই। এ কথা বলা বহুল্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অতুলনীয় একজন লেখক ও দার্শনিক। তিনি মূলতঃ পূর্ববঙ্গে আসেন তাঁর পারিবারিক জমিদারি পরিচালনা ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। তবে এদেশের সমাজ ও প্রকৃতি তাঁর সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাঁর সাহিত্য কর্মের একটি বিরাট ও প্রধান অংশ বাংলাদশ তথা শিলাইদহ ও কুষ্টিয়া কুঠিবাড়িকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে। তবে একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, তিনি এদেশে এসেছিলেন ব্যবসা করতে। তাঁর মতো দয়াদ্র মানুষের পক্ষে জমিদারি বা ব্যবসা ফলপ্রসূ হবার কথা নয়। আদতে রবীন্দ্রনাথের সময়ে শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও নওগাঁয়ের জমিদারী খুব বেশি লাভের মুখ দেখেনি। আর কুষ্টিয়া কুঠিবাড়িকে কেন্দ্র করে তিনি যে ব্যবসা শুরু করেন তা মাত্র ১০-১২ বছরের মধ্যেই লাটে ওঠে। অবশেষে বিপুল ক্ষতি মাথায় নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের শেষের দিকে। এর দুই বছর পরে ১৮৯১ সালে তিনি ভূষি মালের ব্যবসা করার কথা ভাবেন। শিলাইদহে গড়ে তোলেন ‘টেগর এন্ড কোম্পানি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায় বিপুল সম্ভাবনা দেখা গেলো- কবি এটিকে সম্প্রসারিত করার কথা ভাবলেন। ১৮৯৫ সালে তিনি ‘টেগর এন্ড কোং’- এর সদর দফতর নিয়ে আসেন কুষ্টিয়ার মিলপাড়ায়। তাঁর এই কাজের সহযোগী হিসেবে থাকেন তাঁরই দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দনাথ ঠাকুর ও বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারা ছিলেন কবির সাথে এই ব্যবসার যৌথ মূলধন বিনিয়োগকারী অংশীদার। টেগর এন্ড কোং মিলপাড়ায় স্থানান্তরের সাথে সাথে ভূষিমালের কারবারের সাথে যুক্ত হয় আখ মাড়াইয়ের কলগাছ ও পাট রোলিং করার মেশিনারি। পরে রবীন্দ্রনাথ এখানে বেশকিছু পোষাক তৈরির তাঁতকল স্থাপন করেন। এটি ছিলো মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর ‘মোহিনী মিলস’ প্রতিষ্ঠার প্রায় একযুগ আগের কথা। তাই কুষ্টিয়াতে ভারি শিল্পের উদ্যোক্তা হিসেবে রেনউইক কারখানার পরে রবীন্দ্রনাথের নাম উপরের দিকেই থেকে যাবে। টেগর এন্ড কোং- এর প্রধান সদরদপ্তর স্থাপিত হয় কলকাতায়।
রবীন্দ্রনাথ কখনও নৌ যোগে কখনও বা রেলপথে কলকাতা থেকে শিলাইদহে আসেন। মিলপাড়ার ব্যবসা দেখভালের জন্য তাঁকে কুষ্টিয়ায় যাত্রা বিরতি করতে হয়। তাঁর থাকা ও অবকাশ যাপনের জন্য ১৮৯৫ সালে টেগর এন্ড কোম্পানির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার পাশে নয় কাঠা জমির উপর নির্মাণ করা হয় দ্বিতল বিশিষ্ট ‘কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি বা টেগর লজ’। উল্লেখ্য যে, এই বাড়ির নাম রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি’ রেখেছিলেন। বাড়িটির চতুর্দিকে রয়েছে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির আদলে নদীর ঢেউ খেলানো প্রাচীর। বাড়িটির পশ্চিম দিকে একটি সুদৃশ্য লোহার পেঁচানো সিঁড়ি। ঐ সিঁড়ি বেয়ে কবি সোজা দোতলায় গিয়ে উঠতেন। শিলাইদহ থেকে কলকাতা গমনাগমনের পথে কুষ্টিয়া কুঠিবাড়িতে যাত্রা বিরতি কালে তিনি যেসব অমর কাব্য রচনা করেছিলেন তা ‘ক্ষণিকা’ এবং ‘কথা ও কাহিনী’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
যা হোক, কবির দুই ভ্রাতুষ্পুত্র যেন ব্যবসা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। কোম্পানিকে প্রতি বছর কেবলই লোকসান গুণতে হচ্ছিলো। শুধুমাত্র পাটের ব্যবসায় তাঁকে ঋণ করতে হয় ঐ সময়ের এক লাখ টাকার উপরে। কবি তবুও হাল ছাড়লেন না। তিনি তাঁর শশুর বাড়ি খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহির উদ্যোমী যুবক যজ্ঞেশ্বর বাবুকে ডাকলেন। তাকে দায়িত্ব দিলেন কোম্পানি দেখাশোনার। যজ্ঞেশ্বরের প্রচেষ্টায় কোম্পানি ঘুরে দাঁড়ালো বটে। তবে কয়েক বছর যেতে না যেতেই আবার লোকসান। এর মাঝে রবীন্দ্রনাথ বিপুল টাকা দেনা হয়ে গেলেন। কবি যেন আর নিতে পারছিলেন না। একসময় তিনি ঘোষণা দিলেন- ‘ব্যবসা আসলে তাঁর জন্যে নয়’।
ত্যক্তবিরক্ত রবীন্দ্রনাথ কোম্পানি বিক্রি করার ঘোষণা দিলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবু নিজেই কিনতে রাজি হলেন। ঐ সময় জমি বাদে শুধু স্থাপনা ও যন্ত্রপাতির মূল্য যেখানে লাখ টাকার উপরে সেখানে কবি মাত্র তিন হাজার টাকায় তা যজ্ঞেশ্বরের নিকট বিক্রি করেন। আর কোম্পানির দুই বিঘা জমি বাৎসরিক ৫০ টাকায় বন্দোবস্ত দেন। পরে যজ্ঞেশ্বর বাবু এখানে ‘যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ধ্বংসাবশেষ এখনও টেগর লজের পাশে বিদ্যমান রয়েছে। আর যজ্ঞেশ্বর বাবুর লাল দালানের দ্বিতল অফিস ভবনও রয়েছে কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ির ঠিক পূর্ব পাশেই। পরে যজ্ঞেশ্বর বাবু কুষ্টিয়া রেনউইক কোম্পানির সাথে যৌথ মালিকানায় ব্যবসা শুরু করেন এবং ঐ কোম্পানির সাথে তার নিজের নামটি এখনও জড়িয়ে আছে।
অনেকেই বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রেলপথে কুষ্টিয়া বড় স্টেশনে এসে নামতেন, তারপর তিনি পালকি যোগে কুষ্টিয়া কুঠিবাড়িতে যেতেন। এই অভিমতটি ঐতিহাসিকভাবে ঠিক নয়। কেননা, মোহিনী মিলের মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে ১৯৬২ সালে ট্রেনলাইন বাঁকা করে শহরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এর আগে ট্রেনলাইন ছিলো জগতি থেকে সোজা গড়াই ব্রিজ। স্টেশন ছিলো হরিশংকরপুর এলাকায়- যা নির্মাণ করা হয় ১৮৭১ সালে। রবীন্দ্রনাথ আসলে হরিশংকরপুরের ঐ স্টেশনটি ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথ সর্বশেষ ১৯২২ সালে শিলাইদহে আসেন এবং কলকাতায় ফেরার পথে হরিশংকরপুরে অবস্থিত কুষ্টিয়া স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকেন। এসময় খবর পেয়ে যজ্ঞেশ্বর বাবু স্টেশনে যান। কবিকে অনেক অনুরোধ করেন কুষ্টিয়া কুঠিবাড়িতে যাওয়ার জন্য, কিন্তু বিমর্ষ কবি কিছুতেই রাজি হননি।
শেষ কথা বলি। অনেকেই দাবি করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় বাংলাকে সমানভাবে ভালোবাসতেন বলে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে তিনি মানতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তিনি উঠেপড়ে লাগেন এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করিয়ে ছাড়েন। আমার এখানে সন্দেহ আছে খুব। পূর্ববঙ্গের জমিদারি ও ব্যবসায়ের টাকা দিয়ে তিনি কলকাতায় ও জোড়াসাঁকোতে আমাদের প্রিয় কবি অনেক অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা এখনও মাথা উঁচু করে টিকে আছে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত কোন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম কেউ বলতে পারবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার প্রসঙ্গ না-ই বা তুললাম।
সর্বশেষ কথা, কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত এক ঐতিহাসিক বাড়ি। ২০০১ সালে বাড়িটি দখলদার মুক্ত করেন প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী। তবে কুষ্টিয়া পৌরসভা একটি অনৈতিক দাবি করে বসে। এ যেন ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’! পৌরসভার দাবি হলো- ভবনটি যেন তাদের অধীনে থাকে। ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর এই ঐতিহাসিক ভবনটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধিভুক্ত হয় এবং রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গেজেট ভুক্ত হয়। কিন্তু কোন এক অজানা ভূতুড়ে কারণে এখন পর্যন্ত ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিজের দখলে নিতে পারেনি। কুষ্টিয়া পৌরকর্তৃপক্ষ এটিকে যাদুঘর ও সংগ্রহশালা হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা নিজেদের মতো যেমন ইচ্ছে তেমন রং করছে এবং কখনও কখনও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করছে, যা এই ঐতিহ্যবাহী ভবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বটে।

Discussion about this post