শেখ জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট থেকে:
রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতি রংপুর অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরায় মঙ্গার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যার প্রধান কারণ আইনশৃঙ্খলার অবনতি। ব্যবসা- বাণিজ্যে স্থবিরতা। এতে করে কয়েক লাখ দরিদ্র জনগোষ্ঠী পড়েছে মহাবিপাকে। অথচ তারা কিছু দিন আগেও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন।
রংপুর অঞ্চল ৮ জেলা দীর্ঘদিন ধরেই কৃষি নির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য সু পরিচিত। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পাটসহ নানা কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের লাখো পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায় রংপুর অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কৃষি উৎপাদনে ঘাটতি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, কৃষকের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, কৃষি উপকরণের সংকট, প্রবাসী আয় হ্রাস, ক্ষুদ্র শিল্পের ধীরগতি এবং শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা মিলিয়ে এখন গোটা অঞ্চলের অর্থনীতি মন্দার ছাপ বহন করছে। সাধারণ মানুষ আতংকে আছে পুনরায় উত্তরের মঙ্গা ফিরে আসে কি- না।
রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতিতে রংপুর অঞ্চলের ৮ জেলা সহ গোটা দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ছেদ পড়েছে। বেড়েছে খুন, হত্যা, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে রাতে সাধারণ মানুষের স্বল্প খরচের বাহন ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা। এই বাহনের একাধিক চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই করা হয়। যার ফলে রাতে স্বল্প আয়ের ও স্বল্প দূরত্বের ব্যবসা পণ্য পরিবহনে ঝুঁকি বেড়েছে। এতে গ্রাম- গঞ্জের কৃষি পণ্য, সবজি-ফল, ভোর বেলা শহরে পৌঁছাতে পারছেনা৷ গ্রামের হাট-বাজার হতে পণ্য সংগ্রহ করে শহরে সময়মত পৌঁছাতে পারছেনা। এতে করে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি পণ্যের ন্যায়্যমূল্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এ পেশার সঙ্গে অনেকে পুঁজি হারিয়ে ফেলে বেকার হয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও সামগ্রিক ভাবে রংপুরের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কোন পরিবর্তন আসেনি। গড়ে উঠেনি কৃষি ভিত্তিক শিল্প। তাই রংপুরের কৃষকদের মূল ভরসা হলো ধান,পাট,ভুট্রা,ফল-মূল, শাক-সবজি, মসলা জাতীয় ফসল ও আলুর উৎপাদন। কিন্তু চলতি মৌসুমে রাজনৈতিক অস্থিরতার দোলাচালে ধান্দাবাজ ব্যবসায়িরা সার ও কীটনাশকের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বাড়িয়েছে। আমন ধানের উৎপাদন প্রত্যাশার তুলনায় কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। একই সাথে আলু চাষের ক্ষেত্রেও চড়াদামে সার ও বীজ কিনে আলু উৎপাদন করে ছিল কৃষক। দাম পাওয়ার আশায় হিমাগারে রেখেছে। কৃষক কাঙ্ক্ষিত আলু দাম পাচ্ছেনা। কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হচ্ছে না। কৃষকের মাঠ থেকে আলু বা ধান সংগ্রহ করে পাইকারি বাজারে নেওয়ার পর মধ্যস্বত্বভোগীরা অধিকাংশ লাভ ঘরে তুলছে।
রংপুর অঞ্চলে কৃষির পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্প ও হস্তশিল্পও গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় ভরসা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প কিংবা খুদে কারখানাগুলোতে চাহিদা ও পুঁজি সংকটের কারণে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। গ্রামীণ নারীদের আয়ের একটি বড় মাধ্যম ছিল পাটজাত পণ্য ও বুটিকস কাজ। তবে বাজার সম্প্রসারণ না থাকায় এবং কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে এসব খাতও টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের কথা শুনে শুনে উত্তরে মানুষের কান ঝালাপালা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রংপুরের নীলফামারীর ইপিজেড ছাড়া লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলার মানুষের জীবনে উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া লাগেনি। দেশের তৃতীয় বৃহত্তর স্থলবন্দর ও দেশের একমাত্র চতুর্থ দেশীয় স্থলবন্দর বুড়িমারী স্থলবন্দর। এই বন্দরে যাওয়া রংপুর, লালমনিরহাট ও বুড়িমারী মহাসড়কটি ফোর লেন হয়নি। রাজনৈতিক কারণে প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়েছে। রংপুর অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে কর্মরত। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী আয় এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চাকরির সুযোগ কমে আসায় নতুন করে কর্মসংস্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বৈধ কাগজপত্র জটিলতা, রেমিট্যান্স পাঠাতে হুন্ডির প্রভাব এবং প্রবাসে মন্দাভাবের কারণে প্রবাসী আয় হ্রাস পাচ্ছে। এতে গ্রামীণ পরিবারগুলোতে নগদ অর্থের প্রবাহ কমেছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে স্থবিরতা তৈরি করছে। এবছর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে রংপুর বিভাগে। রংপুর অঞ্চল খরা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সংবেদনশীল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কখনো অতি বৃষ্টিপাত, কখনো দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম কৃষিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ অঞ্চলের তিস্তা নদীর নাব্য সংকট এবং পানি প্রবাহের অনিশ্চয়তা কৃষি উৎপাদনে বড় প্রভাব ফেলছে। ফলে কৃষকরা একদিকে উৎপাদন ব্যয়ে চাপে পড়ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে।
কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই বর্তমানে ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছেন। এনজিও, ব্যাংক ও বিভিন্ন মহাজন থেকে ঋণ নিয়ে কৃষিকাজ কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কিন্তু উৎপাদন ও বিক্রি থেকে পর্যাপ্ত লাভ না হওয়ায় ঋণ পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে কৃষিতে ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত, ক্ষুদ্র শিল্পে সহজ ঋণপ্রদান এবং প্রবাসী শ্রমবাজার সম্প্রসারণ জরুরি। কৃষি শ্রমিকদের (নারী- পুরুষের) মজুরি বৈষম্য দুর করতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় কৃষকের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হতে পারে।
এদিকে জনৈক সমাজ সেবক জানান, রংপুর অঞ্চলের মানুষের দুঃখ ছিল মৌসুমি অর্থনৈতিক মন্দা। যাকে এ অঞ্চলের মানুষ মঙ্গা বলে পরিচয় দিয়ে আসছিল। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে সামাজিক সুরক্ষা, ভাতা সহ নানা উদ্যোগের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার দিকে এগুতে ছিল। ২৪ এর পর নতুন প্রজন্ম ও নতুন সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। সেদিক এগুতে ছিল কিন্তু অদৃশ্য রাজনৈতিক কারণে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বরং অবনতি ঘটেছে। যার প্রভাব পড়েছে রংপুরে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।

Discussion about this post