শেখ সুদীপ্ত শাহীন, লালমনিরহাট:
পানির উৎসের সন্ধানে সত্য যুগে জমিদারের দু’কন্যার আত্মবলিদানের স্মৃতি ও সৌভাগ্যের প্রতীক সনাতন ধর্মাবলির সিন্দুরমতি মেলা। এক সময় গোটা ভারত বর্ষের হাজার বছরে ঐতিহাসিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন ছিল সিন্দুরমতি মেলা। কয়েক শত বছর ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বী চৈত্র মাসের নবম তিথিতে পূণ্যস্নান করে আসছে। এই সনাতন ধর্মীয় উৎসবে কে ঘিরে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলা বসে সিন্দুরমতি পুকুর পাড়ে। এই সিন্দুরমতি পুকুরে পূন্যস্নন করাকে সনাতন ধর্মীয় মানুষ সৌভাগ্য মনে করেন। সিন্দুর মতি মেলা কে মুসলিম সম্প্রদায় মাছের মেলা হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই দিন মেলা বিশাল আকৃতির মাছ, মিষ্টি মন্ডার পসরা বসে মেলায়। মেলাকে ঘিওে কয়েক শত কোটি টাকার গ্রামীণ গৃহসামগ্রী কৃষি সরঞ্জাম বিক্রি হয়ে আসছে।
মূলত দেশের মধ্যে সব চাইতে পুরনো ঐতিহাসিক মেলা এটা। হিন্দু ধর্মের সৃস্টির সাথে এই মেলার ধর্মীয় অনুভুতি জড়িত। চৈত্র মাসের নবম তিথিতে পূণ্যস্নানে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বক্ষ্মপুত্র নদে স্নানের প্রথার সাথে সিন্দুরমতি পুকুরে স্নানের ইতিহাস জড়িত।
এখন মেলায় মিলে স্বল্পমূল্যে গৃহস্থালি ও কৃষি সামগ্রী। নানা রমক মিষ্টান্ন, রসগোল্লা, চমচম, জিলাপি, দৈই, খৈ, মুড়ি, মুড়কি, চিড়া কত কী। উঠেছে গ্রামীণ সব্জি, উরুন, গাইন, কাস্তে, খন্তা, হাতুরি ইত্যাদ্দি। কী নেই মেলায়? সিন্দুরমতি মেলাকে সৌভাগ্যের মেলাও বলে। জমিদারের দুই কন্যা মানব সন্তান হয়ে তাদের আত্নত্যাগের পুরস্কার হিসেবে দেবত্বর লাভ করে। তারা চির অমরত্ব লাভ করে। তাই অমরতে¦র মেলা এটা।
আজ বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী লালমনিরহাট জেলা সদর পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে সিন্দুরমতি পুকুর পাড়ে ঐতিহাসিক সিন্দুরমতি মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এবারের মেলায় কোন অশ্লীল মাইকের গান, জুয়া, যাত্রা নেই। সিন্দুরমতিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভুতির প্রতি সম্মান রেখে সকল আয়োজন করা হয়েছে। সনাতন ধর্মের মানুষ পুকুরে ¯œাান করে পূণ্য লাভ করে পাপমুছোন হয়ে যায়।
১৬.০৫ একর আয়তনের বিশাল দিঘী এটি। ১৩ একর জলমগ্ন থাকে সব সময়। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ঐতিহাসিক দর্শনীয় মেলা হয় সিন্দুরমতি মেলা ও সিন্দুরমতি দিঘী এটি। হিন্দুধর্মের মানুষদের এটি ধর্মীয় তীর্থ স্থান। পুকুরটি খননে ঐতিহাসিক তথ্য সরকারিভাবে সংরক্ষিত নেই। দিঘীকে ঘিরে জনপদে নানা উপাখ্যন/ পৌরানিক কিচ্ছা-কাহিনী চালু আছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বী বয়োঃবৃদ্ধ গণ জানান, জনৈক হিন্দু জমিদার নারায়ন চক্রবর্তী প্রজাদের মিঠা পানি উৎস তৈরি করতে পুকুরটি সত্য যুগে খনন করে। অত্র অঞ্চলের মানুষের খরা জর্ণিত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে। এই পুকুরে পানি আনতে জমিদার কে চরম মূল্য দিতে হয়।
বিশাল পুকুর টি গভীর খননে পর তলদেশ হতে পানি উঠছিল না । তখন রাজা স্বপ্নাদেশ পায় তার সতী দুই কুমারী কন্যা সিন্দুর ও মতি -কে নিয়ে পুকুরের মাঝস্থলে পূজা দিতে হবে। দেবতাদের সন্তুষ্টিতে পুজোর সকল আয়োজন চুড়ান্ত হয়। সেই সময় জমিদার দেখতে পায় দেবতার উপাচারে দূবলা ঘাস নেই। কিছু না বলে দুবলা ঘাস আনতে উপরে উঠে আসে জমিদার। তখন হঠাৎ জল এসে পুকুরটি কানায় কানায় ভরে যায়। তার কন্যা দ্বয় পুজা অর্চনা শুরু করে দিয়ে ছিল। পুরোহিত অনেকেই নিরাপদে পুকুরের জল হতে পাডে উঠে আসতে সক্ষম হয়। জমিদারের কন্যা দ্বয় সিন্দুর ও মতি উঠে আসতে না পেরে অথৈ জলে সলিল সমাধি হয়। পানির জন্য জমিদার কন্যার এই আত্মত্যাগের স্মৃতি বিজরিত সিন্দুরমতি পুকুর। জমিদার স্বপ্ন প্রাপ্ত হয় কন্যা দ্বয় মানবী হতে দেবতর¡ লাভ করেছে। তাই তারা চির অমর।
এমনও প্রচার আছে। দেবত্বর লাভের বহুদিন পর, এক সন্ধ্যাবেলা জনৈক বাইন্ন্যা (স্বর্ণাকার) তার হাতের তৈরি স্বর্ণালংকার নিয়ে দিঘীর ধার দিয়ে নিজ গৃহে যাচ্চিল। তখন দুই বোন পুকুরের জলে হতে ভেসে উঠে স্বর্ণাকার নোলক ও কানের দুল দেখতে চায়। তারা দুল ও নোলক কিনে নেয়। নগদ মোহরের বিনিময়ে জমিদার পিতার উদ্দেশ্যে চিরকুট লিখে দিয়ে বলে ” বাবার কাছে চিরকুট দেখালে মূল্য মিটিয়ে দেবে। এভাবে দেবত্বর লাভের কথা চাউর(প্রচার) হয়।
সত্য যুগে মন্দিরে পূজা, বিয়েতে দিঘী পাড়ে এসে পুজোর ডালা চাইলে ভেসে আসত। পূজা শেষে ডালা পুকুরে ভাসিয়ে দিয়ে যেত। এটি পণ্য পুকুর। সবকিছু ভাল ভাবে চলছিল। এক লোভী প্রজা স্বর্ণের পুজোর ডালা নিয়ে ফেরৎ দেয়নি। সেই দিনের পর পুজো ডালা ভেসে উঠা বন্ধ হয়। নানা কিংবদন্তি রয়েছে ৪টি সেচ যন্ত্র দিয়ে পুকুর শুকাতে গিয়ে চকমপদ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সেই গল্প লোকমুখে। সনাতন ধর্ম বিশ্বাস , ব্রহ্মপুত্র ও দিঘীর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এক গুপ্ত সুরঙ্গ দিয়ে পুকুরটির সাথে ব্রম্মপুত্র নদের সংযুক্তি রয়েছে।
১৯৭৫, ২০০৩ ও ২০১২ সালে সরকার। সংস্কার করে পুকুরটি। দিঘীর দক্ষিণে বেশ বড় আধুনিক শৈল্পিক শানবাঁধানো ঘাট নির্মাণ করা হয়। পূন্যস্ন্যানে আসা মহিলাদে ঘাট সংলগ্ন ‘ফ্রেসরুম’ নির্মাণ করা হয়। পাড়ে প্রাচীন আম, বট, পাইকর গাছ আছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ৫টি পৃথক বিগ্রহের মন্দির আছে। যথা ক্রমে- দূর্গামন্দির, কালীমন্দির, রাধা-গোবিন্দ মন্দির, শিবমন্দির, সিন্দুরমতি মন্দির। নতুন একটি লোকনাথ ব্রাহ্মণচারীর মন্দির নির্মাণ হচ্ছে। তবে দূর্গামন্দিরটি প্রাচীন মন্দির ।
মন্দিরের সামনে পুকুরে দন্ডয়মান পাথরের খুঁটি ছিল। তার গায়ে প্রাচীন হরফে লিখা ছিল কিন্তু এখনো পাঠ উদ্ধার করা যায়নি। পাঠ উদ্ধার হলে প্রকৃত ইতিহাস ঐতিহ্য জানা যেত। পুকুর সংস্কারের সময় তামার মুদ্রা, খননাস্ত্র, গহনা, সোনা-রূপা ও রাম-লক্ষণের ধাতব মূর্তি পাওয়া যায়। যা জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত আছে। যাদু ঘরে পাঠ উদ্ধারে পাথরের পিলারটিও নিয়ে গেছে।
সিংহল (শ্রীলংকা) এক সম্ভান্ত জমিদার। শ্রী রাজনারায়ণ চক্রবর্তী। স্ত্রী শ্রীমতি মেনকা দেবীর কন্যা ছিল সিন্দুর ও মতি। বছর চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে এখানে স্নানোৎসব শত শত বছর ধরে হয়ে আসছে। বাংলার বিখ্যাত সবচেয়ে পুরনো মেলা এটি। এই পুকুর পাড় হতে প্রায় ১০ কিঃমিঃ দুরে একই ইউনিয়ন পঞ্চগ্রামে ৬৯ হিজরির পুরনো সাহাবা মসজিদ রয়েছে। এই সব প্রাচীন নির্দেশন বলে এক সময় সমৃদ্ধ জনপদ ছিল এটি।
মেলায় উপলক্ষে গ্রামীণ নানা তৈজসপত্র, গৃহসহায়ক সামগ্রী, মনোহর সামগ্রী, কৃষি সরঞ্জাম, মিষ্টি, মিঠাইয়ের পসরা সাজিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এই মেলার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মেলায় বিশাল বিশাল মাছ বিক্রি হয়। মেলাকে ঘিরে সারা দেশ হতে মাছ এখানে আনা হয়।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post