সুদীপ্ত শাহীন, লালমনিরহাট:
সগৌরবে ৭৫ বছরে পা রাখছে লালমনিরহাটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চার্চ অভ্ গড উচ্চ বিদ্যালয় ( মিশন স্কুল) ।
আজ শনিবার ১৭ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ের চত্বরে প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তিতে ব্যাপক বর্নাঢ্য মিলন মেলা বসেছিল নতুন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের।গৌরবের ৭৫ বছর উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন ৮৫ সালের ব্যাচের প্রাত্তন ছাত্র বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম এমপি।
৭৫ বছর পূর্তি উৎযাপনে ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করেছে বিদ্যালয়টির প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। ৭৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান সফল করতে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় বিদ্যালয়। তোরণ নির্মাণ করা হয়। মাঠে বিশাল প্যান্ডেল তৈরিকরা হয়েছে। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের লেখা নিয়ে প্রকাি শত হয়েছে স্মরণিকা।
চার্চ অভ্ গড উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহিদার রহমান জানান, ৭৫ বছর পূর্তিতে ঐতিহ্যের অংশ হতে যাচ্ছে স্কুলটি। এই ঐতিহাসিক দিনটির সাথে থাকতে পেরে গর্বিত মনে করছি। চেষ্টা করব তার গৌরবময় উজ্জল দৃষ্টান্তের শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আনতে।
লালমনিরহাট শহরের প্রাণ কেন্দ্রে খ্রিষ্টান মিশনারি দ্বারা পরিচালিত ছিল স্কুলটি। আধুনিক বিজ্ঞামনস্ক মানুষ তৈরিতে ও শিক্ষা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে স্কুলটি। অত্রাঞ্চলে ১টিই সম্ভবত আধুনিক শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। এই স্কুলটির পাশে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় (চার্চ) অবস্থিত। এই মিশন স্কুল ও মিশন চার্চের নামের নামেই শহরের প্রাণ কেন্দ্রটি পরিচিতি অর্জন করে মিশন মোড় নামে। ভারত বিভাজনের মাত্র এক বছর পূর্বে অবহেলিত রংপুর অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ১৯৪৬ সালে চার্চ অভ্ গড উচ্চ বিদ্যালয় শিশু শ্রেণি হতে ৮ম শেণি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত এই সময় এখানে খৃষ্টান মিশনারী ১টি চার্চের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়। অত্র এলাকার খৃষ্টান মিশনারি দারিদ্র-পীড়িত পরিবারের অনাথ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে মিশন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন খ্রিষ্টান মিশনারীরা। সেখানে অনাথ শিশুদের পাশাপাশি অত্রাঞ্চলের শিশুদের পড়াশুনার সুযোগ দিতেন। অনাথ শিশুদের আবাসিক সুবিধা দিয়ে পৃথক হোষ্টেলে ছেলে ও মেয়েদের রেখে পড়াশুনা সুযোগ পেত। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন সুখময় সমাদর। শুরুর দিকে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান হতো সম্পূর্ণ মিশনারীদের খরচে। পরে ১৯৭৫ সালে জুনিয়র স্কুল হিসেবে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়। ১৯৮৫ সালে উচ্চ বিদ্যালয় চালু হয়। প্রথম মানবিক বিভাগ হতে ১৯৮৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা অংশ নেয়। এরপর ১৯৮৯ সালে বিজ্ঞাণ বিভাগ চালু হয়। এই স্কুলের বিজ্ঞাণ বিভাগের এসএসসি প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন এই প্রতিবেদক সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম শাহীন। বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র কুমার বাঢ়ৈ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এই স্কুলের শিক্ষার্থী ও খৃষ্টান মিশনারিদের অবদান ছিল গৌরবের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা মিশনের অধিবাসী ও কর্মকর্তা গণ পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার ও হত্যার শিকার হয়। তাদের অপরাধ তারা আধুনিক শিক্ষায় সমাজকে আলোকিত করেছে। মানুবিক মানুষ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী মহানমুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে ছিল। এ কারনে পাকিস্তানি সেনারা হাতে নির্মমভাবে শহীদ করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র কুমার বাঢ়ৈসহ খৃষ্টান মিশনারির অনেককে। দাপ্তরিক নাম চার্চ অভ্ গর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কিন্তু জেলায় সকলে মিশন স্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে। শুরুতে মিশনারী চার্চের অধীনে স্কুলের ব্যয় নির্বাহ করা হত। ১৯৮২ সালে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হয়। তখন হতে স্কুল পরিচালনা ব্যয় মিশনারী হ্রাস করে দেয়। ২০২১ সালে উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে স্কুলটি এমপিও ভুক্ত হয়। গৌরবময় ৭৫ বছরে শত শত মেধাবী শিক্ষার্থী গড়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তারা বিচারক, সামরিক কর্মকর্তা, বিজ্ঞাণী, অধ্যাপক, সচিব, মন্ত্রী, এমপি পর্যন্ত হয়েছে। দেশে বিদেশে এই প্রতিষ্ঠানের কয়েক শত শিক্ষার্থী উচ্চ মর্যাদার পেশায় জড়িয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪২৯ জন শিক্ষার্থীর পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৭ জন। যার মধ্যে এমপিও ভুক্ত হয়েছেন ১০ জন। বাকীরা মিশনারী ও টিউশন ফি’র অর্থ সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকে। প্রাথমিক বিভাগে অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয় বিদ্যালয়টির সব শিক্ষককে। মিশনারীর দান করা ১.৩১ একর জমিতে বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি। লালমনিরহাট শহরের একদম প্রাণকেন্দ্র অবস্থিত এটি। বিদ্যালয়ে ৫টি একাডেমিক ভবন, একটি বিজ্ঞানাগার, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে নিজস্ব অর্থায়নে ল্যাব রয়েছে। তবে তথ্য প্রযুক্তি ল্যাবটিতে প্রজেক্টর ছাড়া কিছু নেই। ১টি কম্পিউটার ল্যাব বা শেখ রাসেল ল্যাবের খুব প্রযোজন। বেশকয়েক বছর পূর্বে চাহিদা পাঠান হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কোন সহায়তা পাওয়া যায়নি। নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠদান চলে বিদ্যালয়ে। নানা কারনে বিদ্যালয়টি তার আগের গৌরবে কিছুটা হলেও ব্যহ্ত হয়েছে। এক সময় ছিল এই বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্কুলে ৯ম ও ১০ শ্রেণিতে নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে ভর্তি করাতেন। সেই স্কুলের রেজাল্ট ভাল করার জন্য। এখন সেই প্রতিযোগীতা নেই। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৮০ শতাংশ।
দৈনিক দেশতথ্য/এসএইচ//

Discussion about this post