Print Date & Time : 8 June 2025 Sunday 5:50 pm

শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক বেশী ; স্কুলে উপস্থিত এক শিক্ষক, এক ছাত্র 

নিজস্ব প্রতিবেদক : কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় একটি সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের হাবাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৩ জন হলেও শিক্ষক রয়েছেন ৪ জন। প্রতিদিন একদুই জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এই স্কুলে শিক্ষকের তুলনায় কম শিক্ষার্থী নিয়েই পাঠদান চলছে।

২০১৩-২০১৪ সালে ‘১৫০ বিদ্যালয়’ প্রকল্পের আওতায় ২০ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে এলজিইডি স্কুলটি বাস্তবায়ন করে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০১৪ সাল থেকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। শুরুর দিকে অনেক ছাত্রছাত্রী থাকলেও বর্তমানে ঠিক উল্টো চিত্র। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত রয়েছেন ৪ জন শিক্ষক। অথচ প্রতিদিনই শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে একদুই জন। 

বুধবার (১৫ মে) সাড়ে ১১টার দিকে স্কুলটিতে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রেণীকক্ষ গুলোর দরজায় তালা ঝুলছে। স্কুলে একজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। অপর তিনজন শিক্ষক ও দুইজন ছাত্র স্কুলে অনুপস্থিত। চারজন শিক্ষক উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও উপস্থিত ছিলেন একজন। শিক্ষকদের অফিস রুমে বসে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোখসানা খাতুন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সোহানকে পড়াচ্ছেন। 

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাবাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৩ জন আর  শিক্ষক রয়েছেন ৪ জন। সোহান দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, মজিদ চতুর্থ শ্রেণিতে এবং সলক প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের চার শিক্ষক হলেন- রোকসানা খাতুন, সাদিয়া খাতুন, ফিরোজা খাতুন এবং শাহিদা খাতুন।  তারা সবাই সহকারী শিক্ষক। তবে রোকসানা খাতুন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।

এবিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোখসানা খাতুন বলেন, আমি ২০১৮ সালে এই স্কুলে যোগদান করি। তখন ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। আস্তে আস্তে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতেই আছে৷ এখন ৩ জন ছাত্র আছে। আমি সহ মোট চারজন শিক্ষক এই স্কুলে দায়িত্ব পালন করছি। আজকে একজন ছাত্র উপস্থিত, দুইজন অনুপস্থিত। তিন শিক্ষক ছুটিতে আছেন।যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা ও আবাসন প্রকল্পের ঘরে বসবাসকারীরা আবাসন ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থী কমে গেছে বলে দাবি করেন এই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। 

দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সোহান বলে, আগে আমার বন্ধু ছিলো। এখন নেই। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আমি একা পড়ি। আগে বন্ধুদের সাথে পড়তে ভালো লাগতো। কিন্তু এখন একা একা ভালো লাগে না। 

স্থানীয়রা বলেন, আবাসন প্রকল্পের ঘর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো না। এজন্য আবাসনের ঘর ফেলে চলে গেছে অনেকেই। একারণে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও পরিবারের সাথে চলে যায়। স্কুলে এখন ৩ জন ছাত্র আর ৪ জন শিক্ষক। শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে আসে না। 

স্থানীয়রা ও আবাসনের বাসিন্দারা বলেন, অযত্নে-অবহেলায় আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর হাবাসপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পটির বেহাল দশা। ভূমিহীনদের স্বপ্নের ঠিকানায় তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। মরিচা ধরে টিনের ছাউনি ও দেয়াল ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। টিউবওয়েল ও শৌচাগারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। আবাসন প্রকল্পের ১২০টি ঘরের মধ্যে ৭০টি ঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাকিগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পরিত্যক্ত ঘরে গরু-ছাগল লালনপালন করা হচ্ছে। বেহালদশার কারণে ৮০ পরিবার আবাসন ছেড়ে চলে গেছে। তারপরও জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভূমিহীন ৪০ হতদরিদ্র পরিবার। দ্রুত সংস্কার করে আশ্রয়ণটি টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন প্রকল্পে আশ্রিতারা। আশ্রিতারা আবাসন ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতেই আছে। 

তারা আরও বলেন, বিদ্যুতের মিটার বিস্ফোরণে আবাসনের ৩০টি ঘর পুড়ে গেছে। সেইসব ঘর সংস্কার করা হয়নি। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে আমার যেসব ঘরে বসবাস করি, সেগুলোও ভাঙাচোরা, ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। জরাজীর্ণ ঘরে আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। ১২টি টিউবওয়েলের মধ্যে ১০টি অনেক আগে নষ্ট হয়ে গেছে। দুটি টিউবওয়েল থাকলেও ঠিকমতো পানি ওঠে না। বাথরুমগুলোও অনেক আগে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। টিউবওয়েল ও বাথরুমের অভাবে আমাদের খুব কষ্ট হয়। অনেক দূরে থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে। নদীর চরে টয়লেট করতে হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভাঙা টিনের ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। ঘরের জিনিসপত্র ও বিছানা ভিজে যায়। আমরা অনেক কষ্টে আছি। এখানে অনেক মানুষ বসবাস করতো। সমস্যার কারণে ৮০ পরিবারের মানুষ চলে গেছে। আমরা ৪০ পরিবার কষ্ট করে পড়ে আছি। টিউবওয়েল ও বাথরুম ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। দ্রুত ঘর সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি।

এবিষয়ে হাবাসপুর আবাসনের সভাপতি আজাদ শেখ বলেন, আমি এই আবাসনে ১৯ বছর ধরে বসবাস করছি। অযত্নে অবহেলায় ও সংস্কারের অভাবে আবাসনের ঘরগুলো জরাজীর্ণ অবস্থা। টিউবওয়েল, বাথরুম, যাতায়াতের রাস্তা ও ঘরের খুবই সমস্যা। এগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ঘরের টিন পচে গেছে, ভেঙে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে এখান থেকে অনেক মানুষ চলে গেছে। ১২০ পরিবারের মধ্যে এখন ৪০ পরিবার এখানে বসবাস করে। বাকি ৮০ পরিবার চলে গেছে। তারা কুষ্টিয়া শহরে ভাড়া বাসায় থাকে, ভ্যান-রিকশা চালায়, কেউ কেউ দিনমজুর। তাদের সাথে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও চলে যাচ্ছে। এজন্য স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এখন মাত্র তিনজন ছাত্র। শিক্ষক রয়েছে চারজন। ছাত্র না থাকায় শিক্ষকরা গুরুত্ব দেয় না৷ স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। 

নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান খোকন, নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নয়ন আলী ও স্কুলের সভাপতি মির্জা হাবিবুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি। 

কুমারখালী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্কুলটিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা খুবই কম। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, আবাসনের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করা হচ্ছে। তাদেরকে একক ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। স্কুলের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমস্যা গুলো সমস্যার সমাধান করা হবে।

খালিদ সাইফুল // দৈনিক দেশতথ্য // ২০ মে ২০২৪