ড. মো হাফিজুর রহমান :
সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সমতা বা ন্যায্যতা (Equity) আনা অত্যন্ত জরুরি এবং সময়ের দাবি। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় দ্বিমুখী মেরুদণ্ড সৃষ্টি করবে যা একটি জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
একমুখী বৈষম্যহীন ব্যবস্থাই গড়ে দেবে একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা কার্যক্রমে কেন একীভূত-বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যস্থার দরকার তার সত্যতা উদঘাটনে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করবো।
১. বৈষম্য হ্রাস ও সুযোগের সমতা (Reducing Disparity and Ensuring Equal Opportunity):
একটি জাতীর জন্য শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মানের তারতম্য থাকলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে শিক্ষাগত বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এতে করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর মানষিক প্রষণা সৃষ্টি হয় যা তাদের মেধার বিকাশের জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। আমাদের সবসময় মনে রাখা দরকার-
ক) আর্থিক সামর্থ্য: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণত বেশি বেতন ও খরচ লাগে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগকে সীমিত করে। সমতা থাকলে আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে সবাই একই মানের শিক্ষা পেতে পারে।
খ) শিক্ষার মান: সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বেতনে ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়। সমতা নিশ্চিত হলে সকল শিক্ষার্থী, তারা যে প্রতিষ্ঠানেই পড়ুক না কেন, সমান মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং সুযোগ পাবে।
২. মানসম্পন্ন শিক্ষকের সহজলভ্যতা (Availability of Quality Teachers):
শিক্ষার মান বহুলাংশে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও প্রেরণার ওপর নির্ভরশীল। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য প্রায়শই দেখা যায় (যেমন: বেতন-ভাতা, অবসরকালীন সুবিধা)।
ক) বেতন ও সুবিধা: বেসরকারি (বিশেষ করে এমপিওভুক্ত) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় প্রায়শই কম বেতন পান এবং কম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এই বৈষম্য দূর হলে মেধাবী শিক্ষকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও থাকতে উৎসাহিত হবেন, ফলে শিক্ষকের মান বজায় থাকবে।
খ) জাতীয়করণ: মাধ্যমিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাকে জাতীয়করণের দাবিও এই সমতা আনার একটি অংশ, যা শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করতে পারে।
৩. জাতীয় শিক্ষাক্রমের কার্যকর বাস্তবায়ন (Effective Implementation of National Curriculum):
দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই শিক্ষাক্রম (Curriculum) ও সিলেবাস অনুসরণ করলেও, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকে।
ক) সম্পদের অভাব: অনেক বেসরকারি বা অপেক্ষাকৃত দুর্বল সরকারি প্রতিষ্ঠানে ল্যাব, লাইব্রেরি, আধুনিক প্রযুক্তিসহ অন্যান্য শিক্ষণ উপকরণের অভাব থাকে।
খ) একই ফলাফল: সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাব্যবস্থায় সমতা থাকলে শিক্ষার্থীরা একই পাঠ্যক্রম থেকে যথাযথভাবে জ্ঞানার্জন করতে পারে, যা পাবলিক পরীক্ষার ফল এবং কর্মজীবনে সমরূপ দক্ষতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Social and Economic Development):
একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় সমতা অপরিহার্য।
ক) মানবসম্পদ উন্নয়ন: সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা সুযোগের দুয়ার খুলে দেয় এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
খ) সামাজিক ন্যায়বিচার: শিক্ষায় সমতা প্রতিষ্ঠা সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি, কারণ এটি নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও বৈষম্যহীন শিক্ষার কথা বলা হয়েছে।
৫. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রোধ (Preventing Commercialization of Education):
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশ এখন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা যখন ব্যবসায় পরিণত হয়, তখন তার মূল লক্ষ্য—জ্ঞান ও নৈতিকতা প্রদান—থেকে বিচ্যুত হয়।
ক) আর্থিক শোষণ: উচ্চ টিউশন ফি, ভর্তি ফি এবং অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খরচ চাপিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের অভিভাবককে আর্থিকভাবে শোষণের সুযোগ পায়। সমতা নিশ্চিত হলে শিক্ষা বাণিজ্যিক পণ্যের বদলে জনকল্যাণমূলক পরিষেবা হিসেবে বিবেচিত হবে।
খ) কোচিং নির্ভরতা: দুর্বল সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার ঘাটতি পূরণের জন্য শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা শিক্ষার ব্যয় আরও বাড়ায় এবং শ্রেণিকক্ষের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। শিক্ষাব্যবস্থায় সমতা থাকলে এই নির্ভরতা কমবে।
৬. শিক্ষা ব্যবস্থায় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা (Establishing Accountability in the Education System):
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি সরকারের নজরদারিতে থাকে, কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব দেখা যেতে পারে।
ক) একই মানদণ্ড: সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষার মান, শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি, এবং সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে একই কঠোর মানদণ্ড ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে।
খ) শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত: বেসরকারি স্কুলের ছোট ক্লাসের সুবিধা অনেক সময় বড় সরকারি বা এমপিওভুক্ত স্কুলে পাওয়া যায় না। সকল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একটি যৌক্তিক অনুপাত এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো নিশ্চিত করা সমতার অংশ।
৭. সামাজিক ঐক্য ও মানসিক চাপ হ্রাস (Fostering Social Cohesion and Reducing Mental Stress):
শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ক) মানসিক চাপ: অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষার জন্য অতিরিক্ত চাপের মুখে থাকে। ধনীরা উন্নত বেসরকারি শিক্ষা বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়, কিন্তু দরিদ্ররা ভালো শিক্ষা না পেয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। সমতা সৃষ্টি হলে এই সামাজিক বিভাজন ও মানসিক চাপ হ্রাস পাবে।
খ) জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি: সকল শিশুকে একই মানের ও নৈতিকতার

Discussion about this post