কমিটি ভেঙেও থামানো যাচ্ছেনা সংঘাত
এনামুল হক, কুষ্টিয়া অফিস : শেখ হাসিনা সরকারের দেশত্যাগের পর হতে অদ্যাবধি দ্বন্ধ সংঘাতে বিপর্যস্ত কুষ্টিয়া বিএনপি। সেই থেকে এই পর্যন্ত, নিজেদের সংঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী। অনেকেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে জেরবার।
কুষ্টিয়া বিএনপির অনেক নেতা, আওয়ামী জায়ান্টদের ফেলে যাওয়া হাটঘাট পুকুর নদী খাল লুটে একমাসেই কলাগাছ থেকে বেড়ে বটগাছ হয়ে গেছেন।
এসব নিয়ে গাদাগাদা অভিযোগ জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় অফিসে। এসব অভিযোগের সুরাহা না হওয়ায় বেড়েছে গোলমাল মারামারি।
এসব নিয়ে দেশতথ্যের প্রতিনিধিরা যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন সেই আলোকে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ‘দলীয় পদ দখলের প্রতিযোগিতা, চাঁদাবাজি ও সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডারবাজি, হাট-ঘাট টোলপ্লাজা দখল, সরকারী ভু-সম্পত্তি, বালি মহল জল মহল দখল, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা দখলে আধিপত্যবাদের জানান দিতে বাড়ছে সংঘাত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলকে কেন্দ্র করে সৃষ্ঠ দ্বন্ধে নেতাকর্মীরা পক্ষভুক্ত হয়ে সংঘাতে জড়াচ্ছেন।
দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দ্বন্ধ সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দলকে গতিশীল করতে সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় জেলাসহ ৬টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা ও ৬৪টি ইউনিয়নের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষনা করা হয়েছে।
এরপর গত বুধবার কেন্দ্রিয় কার্যালয় হতে রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক পত্রে কুষ্টিয়া পৌর বিএনপির সভাপতি কুতুব উদ্দিনকে আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী জাকির হোসেনকে সদস্য সচিব করে দুই সদস্যের কমিটি ঘোষনা করা হয়েছে।
তারা খুব শীঘ্রই সব ইউনিটের সাংগঠনিক কমিটিও ঘোষনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
আসন্ন ওইসব কমিটিতে পদ পদবি দখলের একটা মনস্তাাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা পূর্ব থেকেই ছিলো। কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় এখন সেই প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
দখলবাজ চাঁদাবাজরা নতুন কমিটিতে ঢুকতে না পারলে তৃণমূল পর্যায়ে আধিপত্য হারাতে পারেন। এমন শঙ্কায় তারা পেশী শক্তি বাড়াতে মরিয়া।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত দেড় মাসে জেলায় বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের আন্ত:কোন্দল ও সংঘাতে ছোট বড় অন্তত: ১৮ টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। পক্ষগণ আগ্নেয়াস্ত্র, দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্রসহ প্রতিপক্ষের উপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।
কুমারখালী থানার পুলিশ পরিদর্শক ও অফিসার ইনচার্জ আকিবুল ইসলাম জানান,
গত ২৮ আগষ্ট সন্ধ্যায় কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের মাজগ্রাম চেয়ারম্যান মোড় এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দ্বন্দের জেরে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে হামলার ঘটনায় দুইজন গুলিবিদ্ধসহ ৬জন আহত হন। এঘটনায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ৭জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এমামলার এজাহার নামীয় দুইজনকে গ্রেফতার করে আদালতে সৌপর্দ করা হয়েছে।
দৌলতপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক ও অফিসার ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান জানান,
গত ৪ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস চত্বরে পূর্ব থেকে চালু থাকা চাঁদাবাজির দখল নিতে উপজেলা বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীরা সংঘাতে লিপ্ত হয়। এতে ৪ জন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এঘটনায় যুবদল নেতা জাফর ইকবাল কর্নেল বাদি হয়ে ছাত্রদল আহ্বায়ক মাসুদুজ্জামান রুবেলসহ ১০জনের নামোল্লেক করে মামলা করেছেন। বলে নিশ্চিত করেন
গত ০৮ সেপ্টেম্বর মিরপুর উপজেলা বিএনপির দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা স্থানীয় বাজারে শো-ডাউন ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটায়। এঘটনায় অন্তত: ৭জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
মিরপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক ও অফিসার ইনচার্জ মোস্তফা হাবীবুল্লাহ জানান, গত ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়ায় পদ্মার তীরবর্তী বালি ঘাটের দখল নিতে ভেড়ামারা-মিরপুরের বিএনপি দলীয় হেবি ওয়েট নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে ৪জন রক্তাক্ত জখম হয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। তালবাড়িয়া বালুঘাটের মারামারির ঘটনায় বালি ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক বাদি হয়ে ১০জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত আর ১০/১৫জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে মিরপুর উপজেলার ঈগল চত্বরে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সমর্থক ও সাধারন সম্পাদক সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এঘটনায় গরুতর আহত সাধারণ সম্পাদক রহমত আলী রব্বানসহ অন্তত: ১০জন হাসপাতালে ভর্তি হন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, এক আ’লীগ নেতার দখলে থাকা বিপুল পরিমান অবৈধ ইউরিয়া সার আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সুত্রপাত। এই ঘটনায় আহত বিএনপি নেতা রহমত আলী রব্বান ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।
মিরপুর থানার ওসি বলেন, গত ০৮ ও ২২ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় এখনও কোন অভিযোগ থানায় আসেনি।
এমন সব ঘটনার প্রেক্ষাপটে মিরপুর-ভেড়ামারা কুষ্টিয়া-২এর বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সুযোগ সুবিধা নিয়ে গড়ে তোলা ব্যবসা-বানিজ্য রক্ষার স্বার্থে রাতারাতি খোলস পালটানো কয়েকজন নেতাকর্মী এসব সংঘাত সৃষ্টি করে দলের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছেন। বারংবার তাগিদ দেওয়ার পরও শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছেনা।
জেলা বিএনপির সদ্য ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব জাকির হোসেন সরকারের বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে দলীয় শৃংখলার কিছু বিঘ্ন ঘটার সংবাদ শুনেছি যা অপ্রত্যাশিত। তাদের আচরণ অসহিষ্ণু। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
সদ্য ঘোষিত কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক কুষ্টিয়া পৌর বিএনপির সভাপতি কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের একটা ক্ষোভ ও তিক্ততার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেউ কেউ হয়ত কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। আবার কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এবিষয়গুলি আমরা নিবিড় ভাবে বিশ্লেষন করছি। ঠিক কি কারনে এমন দলীয় শৃংখলা পরিপন্থী ঘটনা ঘটছে সেগুলি সনাক্ত করে খুব শীঘ্রই একটা উত্তোরনে পথ বের করতে পারবো’।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪//

Discussion about this post