তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা তিনটি মা বন্যহাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে বন বিভাগ।
এ লক্ষে গাজীপুর সাফারী পার্ক বা দেশের অন্য কোনো স্থান থেকে হাতি স্থানান্তর করে পুনর্বাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বিশেষায়িত কারিগরি কমিটি সম্প্রতি লাঠিটিলা বন পরিদর্শন করেছে।
প্রধান বন সংরক্ষকের কার্যালয় থেকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় গঠিত এ কমিটি গত শনিবার ৬ই সেপ্টেম্বর থেকে সোমবার ৮ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী এ বনাঞ্চল পরিদর্শন করেন।
এ সময়ে কমিটি লাঠিটিলায় হাতি পুনর্বাসনের উপযোগিতা, বনাঞ্চলের অবকাঠামো, খাদ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সম্ভাবনা যাচাই করা হয়। বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কমিটির পরিদর্শনকালীন সময়ে স্থানীয় বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিত থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বন অধিদপ্তর মনে করে, হাতি সংরক্ষণ ও প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা গেলে দেশের অন্যতম এই বনাঞ্চল হাতি সংরক্ষণ কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এ সভায় উপস্থিত ছিলেন, ড. মোহাম্মদ আলী রেজা খান, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, প্রাক্তন প্রিন্সিপাল ওয়াইল্ডলাইফ স্প্রেসালিসট, দুবাই সাফারী পার্ক। ড. মোঃ মোখলেছুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মোঃ আব্দুল মোতালেব, হাতি বিশেষজ্ঞ ও ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক, আরণ্যক ফাউন্ডেশন, ঢাকা। মোহাম্মদ আশিকুর রহমান সমি, বন্যপ্রাণী গবেষক, মোহাম্মদ সুলতান আহমেদ, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, আইইউসিএন বাংলাদেশ। সানাউল্লাহ পাটুয়ারী বন সংরক্ষক, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল, ঢাকা। জহির উদ্দিন আকন্দ, বন সংরক্ষক, কেন্দ্রীয় অঞ্চল, ঢাকা। আবুল কালাম, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট (সদর দপ্তর: মৌলভীবাজার) মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, সিলেট বন বিভাগ, নাজমুল হুসাইন, জুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তা, স্থানীয় বন বিভাগ ও লাঠিটিলা বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যা হাবিলদার মোঃ ফারুক আহমেদসহ স্থানীয় জনসাধারণ, বন জাগিরদার ও হেডম্যান প্রধান প্রমুখ।
তখন হাতি পুনর্বাসন প্রকল্পের প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে স্থানীয়দের সাথে মতবিনিময় করে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এছাড়া সুনির্দিষ্ট এলাকায় হাতি সংরক্ষণের সম্ভাবনা, স্থানান্তর প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সম্পর্কে পরামর্শ গ্রহণ করা হয়।
বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লাঠিটিলা বনবিটের অধীনে ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গা রয়েছে। মৌলভীবাজারের ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সিলেট বনবিভাগের জুড়ী ফরেস্ট রেঞ্জের লাঠিটিলা পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ। ২০১৫ সালের সর্বশেষ পরিমাপ অনুযায়ী বর্তমানে সংরক্ষিত বনের আয়তন ৮০ বর্গকিলোমিটার। এরমধ্যে লাঠিটিলার আয়তন ২০ বর্গকিলোমিটার।
জুড়ীর লাঠিটিলা এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা হলে তাদের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, দীর্ঘ চার যুগ আগে ভারতের আসাম রাজ্যে থেকে আসা একদল বন্যহাতি বিচরণ করতো পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টে। দুই এক বছর আগেও পাথারিয়া বনে দল বেঁধে বিচরণ করতো এই হাতিগুলো। মাঝে মধ্যে আসা-যাওয়া করতো ভারতের আসাম রাজ্যের কিছু জায়গায়। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি হাতি মারাগেছে ভারতের অংশে বর্তমানে এদের সংখ্যা ৩ টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে লাঠিটিলায় বন ও বন্য হাতির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের নিরাপদ বসবাসও নিশ্চিত করা হবে। পরবর্তী ধাপে বিষয়টি বাস্তবায়নের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হবে।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির বলেন, “বন ও পরিবেশ কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়- এগুলো সবার সম্পদ। দেশের মধ্যে লাঠিটিলা বন একটি সমৃদ্ধ বন হিসেবে পরিচিত। আমরা বনটি হাতির জন্য কতটা উপযোগী তা সঠিকভাবে জরিপ করে দেখবো। যদি দেখা যায় হাতির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা রয়েছে, তবে সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।
তিনি বলেন, সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা অবশ্যই ভালো কিছু করতে পারবো। তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেটি সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখবে বন বিভাগ। পাশাপাশি বন জাগিদারদের প্রতি আহ্বান থাকবে- লাঠিটিলা বনের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি বজায় রাখতে সকলে একসাথে কাজ করতে হবে।”
বন সংরক্ষক বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল ঢাকা, সানাউল্লাহ পাটুয়ারী বলেন, “সিলেটের এই অঞ্চলে হাতির আধিবসতি ছিল—এটি কেউ প্রত্যক্ষ করেছেন, আবার কেউ শোনেছেন। সরকার চায়, এই এলাকায় হাতিকে কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিশ্চিত করতে।
তিনি আরও বলেন, কাগজপত্র অনুযায়ী হাতির মালিক সিলেটেই সবচেয়ে বেশি, তাই এ অঞ্চলে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব। হাতি বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন, যেন মানুষের সঙ্গে হাতির কোনো সংঘাত না ঘটে এবং ফসল ও ঘরবাড়ির ক্ষতি এড়ানো যায়। এ বিষয়ে বন বিভাগ সচেতনভাবে পদক্ষেপ নেবে।”
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আলী রেজা খাঁন বলেন, হাতির স্বাভাবিক বসবাসের জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা থাকা জরুরি। এমন জায়গা না থাকলে হাতিকে বন্দী রাখা সম্ভব নয়। “হাতি স্বাভাবিকভাবেই জানে কোন জায়গা তাদের জন্য নিরাপদ। তবে ভারতের মতো দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে হাতির ওপর অত্যাচার অনেক কম।”
তিনিও আরও বলেন, “সরকার যদি হাতির প্রজনন গুলোকে আনে, তবে সরকারি ভূমিতে একটি বিশেষ এলাকা ঘোষণা করা হবে। সেখানে তাদের চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। মাহুতদের মাধ্যমে হাতির পরিচর্যা করা হবে। বিদেশে হাতিগুলোকে সুন্দরভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে এত বড় এলাকা বা এত হাতি নেই। তাই ছোট উদ্যোগে বন্যহাতির সঙ্গে মিশে কাজ করা হবে। হাতি অত্যন্ত স্মরণশক্তি সম্পন্ন প্রাণী; তারা গন্ধ শুঁকে তাদের বংশ বা গোষ্ঠি চিনতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কার হাতিগুলো একই বংশের।”