এনামুল হক কুষ্টিয়া: প্রথমে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা জালিয়াতি করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি। এরপর নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল তৈরি, নিয়োগ বোর্ডের সদস্যদের সই – সিল জালিয়াতি করে নিয়োগ সম্পন্ন করে নিয়মিত বেতন উত্তোলন করা হচ্ছে।
বর্তমানে বিধি বহির্ভূতভাবে বিএড সনদের ভিত্তিতে বেতন স্কেল প্রাপ্তির জন্য রেজুলেশন বিকৃতি এবং প্রধান শিক্ষকের সই – সিল জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে দুই স্কুল শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কালিগঙ্গা নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ওহিদ – উজ – জামান তাঁর বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সামছুজ্জামান মুকুল ( কৃষি শিক্ষা) ও মোছা. মুসলিমা খাতুনের ( সমাজবিজ্ঞান) বিরুদ্ধে এমন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। তিনি ২০ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) এবং জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লিখিত অভিযোগের সুত্র ধরে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে মিলেছে অভিযোগের সত্যতা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওহিদ উজ জামান বলেন, তিনি ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যোগদানের আগেই ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে সহকারী শিক্ষক পদে মোছা. মুসলিমা খাতুন নিয়োগ নিয়েছেন। আর ২০০৩ সালের ১২ মার্চ স্থানীয় দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা পত্রিকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ নিয়েছেন মো. সামছুজ্জামান মুকুল। তাঁদের নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে সুপারিশকারী বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি, কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্যদের সই – সিল জালিয়াতি করা হয়েছে।
তাঁর ভাষ্য, জালিয়াতির করে মুসলিমার নিয়োগ ২০১৫ সালে এবং মুকুলের নিয়োগ ২০০৩ সালে দেখানো হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যাঁর তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোতে ( ব্যানবেইস) রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, নিয়োগ পক্রিয়া জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক মুকুল ও মুসলিমা নিয়মিত বেতন ভাতা তুলছেন। সম্প্রতি এই দুই শিক্ষক বিদ্যালয়ের অনুমতি কিংবা কোনো প্রকার ছুটি না ছাড়াই রেজুলেশন ও আমার সই সিল জাল করে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে সেই ডিগ্রীর ভিত্তিতে বেতন স্কেল প্রাপ্তির জন্য আমার নিকট আবেদন দেন। কিন্তু নিয়ম বহির্ভূত আবেদন গ্রহণ না করায় তারা আমার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। এ ছাড়াও আমার বিরুদ্ধে আদালতর মামলা করেছেন। আমি তদন্ত সাপক্ষে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির প্রত্যাশায় লিখিত অভিযোগ করেছি।
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের নগর সাঁওতা, পাহাড়পুর এলাকায় ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কালিগঙ্গা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি। ২০২২ সালের জুলাই মাসে বিদ্যালয়টিকে এমপিও ভুক্ত করেন সরকার। সেসময় তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অভিযুক্ত শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তকরণের জন্য লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্যরা।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত পত্রিকায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর পত্রিকার সঙ্গে কালিগঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কাটিং লাগানো। তবে কাটিং বিজ্ঞপ্তির অক্ষরের সঙ্গে সমকালে প্রকাশিত অক্ষরের সামঞ্জস্য নেই। আবার ওই তারিখে প্রকাশিত ই – পেপারে কালিগঙ্গা বিদ্যালের কোনো বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও এই ভুয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সহকারী শিক্ষক পদে মুসলিমা খাতুনের নিয়োগে প্রধান শিক্ষক দেখানো হয়েছে মো. সাইফ উদ্দিন ফরিদকে। যিনি ২০১৫ সালের আগেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া কিয়েটে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। একইভাবে স্থানীয় দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা পত্রিকা জালিয়াতি করে নিয়োগ দেখানো হয়েছে মো. সামছুজ্জামান মুকুলকে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কুষ্টিয়া পুরাতন কাটায়খানা মোড়ে অবস্থিত কিয়েটে দাপ্তরিক কাজ করছেন মো. সাইফ উদ্দিন ফরিদ। এ সময় তিনি বলেন, আমার সময়ে বিদ্যালয়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মুকুল ও মুসলিমাকে আমি চিনিনা। কোনো কিছু ঘটে থাকলে তা জালিয়াতি করা হয়েছে।
অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক মো. সামছুজ্জামান মুকুল ও মোছা. মুসলিমা খাতুন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পক্রিয়া বৈধ না অবৈধ তা তাঁদের দেখার বিষয় নয়। এ গুলো বুঝবে সভাপতি আর প্রধান শিক্ষক। শিক্ষা কর্মকর্তারা কয়েক দফা যাচাই বাছাই করেই এমপিও ভুক্ত করেছেন। বেতন তুলছি নিয়মিত।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে সাবেক ভারপ্রাপ্ত এক প্রধান শিক্ষক বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক সভাপতি মহব্বত হোসেন, অভিযুক্ত শিক্ষক ও তাঁদের স্বজনরা ২০১৬ সালের দিকে ভুয়া কাগজপত্রাদি তৈরি করেছিল।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গাঁ ঢাকা দিয়েছেন সাবেক সভাপতি মহব্বত হোসেন। তাঁর মুঠোফোনটিও বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জালিয়াতি হলে ওই শিক্ষকের সব পক্রিয়ায় জালিয়াতি ও অবৈধ বলে জানিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাজমুল হক। তাঁর ভাষ্য, অভিযুক্ত শিক্ষকদের এমপিও তিনি যোগদানের আগে করা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ নেওয়া একটি বড় অপরাধ। প্রধান শিক্ষক লিখিত অভিযোগ করেছেন। শিক্ষা কর্মকর্তাকে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু তৈয়ব মো. ইউনুস আলী বলেন, যাচাই বাছাই করে ভুয়া প্রমাণিত হলে বিধি মতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করা হবে।

Discussion about this post