Print Date & Time : 22 April 2025 Tuesday 4:05 pm

সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজ বাড়াচ্ছে কিছু মিডিয়া হাউজ

দৈনিক দেশতথ্য: একটা সময়ে আশপাশের টাউট সংবাদ কর্মীদের দেখে ভাবতাম মিড়িয়া হাউজ কেন এদের নিয়োগ দেয়। কেন “ডান্ডি কার্ড” দেয়। এখন ভাবি, টাউট মিডিয়া হাউজগুলো
কেন জেলা-উপজেলার সংবাদকর্মীর নামে ভংঙ্কর চাঁদাবাজ ও টাউট বানাচ্ছেন!

আশির দশকের মাঝামাঝি ময়মনসিংহের মাসকান্দা থেকে শেখ হাবিবুর রহমানের সম্পাদনায় বের হতো “দৈনিক জাহান। এই কাগজটি অনেককে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হতে সহযোগিতা করেছে। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদের সাংবাদিকতা দৈনিক জাহান দিয়েই শুরু।

আর জাফর সাহেবের রেফারেন্সে দৈনিক জাহানের সাংবাদিক ময়মনসিংহ শহরের বাসিন্দা, প্রণব রাউতের সাথে পরিচয় হয়। তিনি ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের টিনশেড়ের সাংবাদিক লনে তিনি বসেছিলেন। তার ছিঁতিপড়া পাঞ্জাবী ও রংচটা স্যান্ডেল দেখে ভেবেছিলাম উনি বোধহয় মোনাজাত উদ্দীনের সিমবল। সে ভুল ভাংতে অবশ্য দেরি হয়নি।

প্রণব বাবু উপজেলা পরিষদের বিজ্ঞাপন নিতে, নয়তো বিল কালেকশন বা বিল পৌঁছে দিতে অনেকবারই মধুপুরে এসেছেন। সংবাদকর্মী হিসাবে অফিস আদালতের বিজ্ঞাপন নেয়াকে এখনো তৃতীয় শ্রেণীর কাজই মনে করি। তাই কখনোই এটির পেছনে ছুটিনি। যাই হোক, তিনি মধুপুর এলে কখনোসখনো অফিসে ফোন দিয়ে সহযোগিতা করতাম। তিনি জেলা পরিষদের বাঙলোতে থেকে ভাড়া না দিয়েই চলে যান বলে অভিযোগও শোনা যেতো।
দৈনিক দেশতথ্য পত্রিকার মাধ্যমে বলতে চাই ১৯৯৮ সালে ময়মনসিংহের দৈনিক “আজকের বাংলাদেশ” পত্রিকায় গোপালপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের মারামারির একটি খবর প্রকাশিত হয়। গোপালপুর সংবাদদাতার বরাতে ছাপানো খবরটি ছিল অতিরঞ্জিত এবং গল্পনির্ভর। ঘটনার দিনই স্থানীয়ভাবে বিষয়টির নিস্পত্তি হয়। থানায় মামলাও হয়নি।

ওই পত্রিকার বাজার টাঙ্গাইল জেলায় কখনো ছিলনা। কোনো স্থানীয় সংবাদদাতা বা পাঠকও ছিলনা। আনন্দমোহন কলেজ পড়ুয়া এক স্টুডেন্ট, যার বাড়ি ওই গ্রামে, তার মুখের বয়ান শুনে, পত্রিকার এক আনাড়ি স্টাফ খবরটিকে তিল তালে পরিণত করেন। পত্রিকা অফিসের সার্কুলেশন বিভাগ, এলাকাবাসিকে জানান দেয়ার জন্য ডাকযোগে গোপালপুর প্রেসক্লাবের ঠিকানায় তিনকপি পত্রিকা পাঠিয়ে দেন। সেটিই সবার নজরে আসে এবং বিভ্রান্তিকর খবরে ক্ষোভ তৈরি হয়।

পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে খবরের প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। ডাকযোগে দুই বার প্রতিবাদ লিপি পাঠানো হয়। কিন্তু ছাপা হয়নি। এর প্রতিবাদ জানাতে এলাকার মুরুব্বীরা স্থানীয় প্রেসক্লাবে আসেন। আমি তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করি, “পাগলে কি কয়, ছাগলে কি না খায়” প্রবাদ। কিন্তু তারা পত্রিকা অফিসে গিয়ে সরাসরি কথা বলা, দেখা করার গোঁ ধরেন।

এর মধ্যে আমার বামচোখে প্রবলেম দেখা দেয়। ডাক্তার দেখানোর জরুরী প্রয়োজনে তাদের প্রস্তাবে সম্মত হলাম। রাধারাণী গালর্স হাইস্কুলের শিক্ষক, মাহমুদপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানসহ চারজনের সাথে ময়মনসিংহ গেলাম। ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিক সাইফুল ইসলামের সহযোগিতা কামনা করলাম। পুরো ঘটনা শুনে তিনি পন্ডিতজী প্রণব রাউতের কাছে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

শেষাবধি গাঙ্গিনার পাড় থেকে হেটে হেটে ওই পত্রিকা অফিসে পৌঁছলাম। নিউজ এডিটরের চেয়ারে বসে আছেন প্রণব রাউত। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর প্রতিবাদপত্রের কপিটা টেবিলে রাখতেই তিনি বলে উঠলেন, এক প্রতিবাদ কবার পাঠানো হয়? মান্নান সাহেব বললেন, প্রতিবাদ তো ছাপা হয়নি। তাই এবার হাতে হাতে দিতে এসেছি।

প্রণব এবার রেগেমেগে বললেন, ঘটনাতো কিছুটা সত্য। তাহলে প্রতিবাদ ছাপাবো কেন? মান্নান বললেন, তাহলে কিছুটাই লিখতেন। বাকিটায় কল্পনা জুড়ে দিলেন কেন? দুজনের বাদানুবাদ থামিয়ে বললাম, একপক্ষের বক্তব্যে ছাপা নিউজটি একপেশে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই ভিন্নপক্ষের বক্তব্য ছাপানোর দাবিটি ন্যায্য। আর এটি পেশাগত কারণে নৈতিকতারও অংশ।

শেষ বাক্যটি শোনা মাত্র প্রণব বাবুজী অসন্তষ্ট হলেন। বললেন, আপনি তো দৈনিক ইত্তেফাকে লিখেন তাইনা? বললাম হাঁ। তারপর বললেন, তিনি শুধু লেখেন না। প্রতিদিন অমন দৈনিক পত্রিকা বানান। কাজেই কোথায়, কখন,কি করতে হয়, তা ভালো বোঝেন, জানেন। তার কথার অহমিকায় স্তম্ভিত হলাম। বললাম, আপনি ‘আজকের বাংলাদেশ’ পত্রিকার নিউজ এডিটর। এ জন্যই প্রতিদিন পত্রিকা বানানোর অহঙ্কারটা দেখাচ্ছেন। কিন্তু আপনি কি এটা জানেন, একই মেশিনে ফেসিয়াল টিসু আর টয়লেট টিসু তৈরি হয়? আর কোনটি কোন কাজে ব্যবহৃত হয় জানেন নিশ্চয়?

তিনি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এডিটর রাজ্জাক সাবের কক্ষে প্রবেশ করলেন। আমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করে সোজা ময়মনসিংহ ধোপাখোলা মোড়ের চক্ষু হাসপাতালে কর্মরত বন্ধু ফারুখ হোসেনের (প্রয়াত) অফিসে রওনা হলাম।

প্রণব অর্থ ইশ্বর স্তুতি। আর রাউত অর্থ রাজপুত। প্রশংসা আর বীরত্ব ভূষণ হলেও প্রণব রাউত আঞ্চলিক সাংবাদিকতায় বীরত্ব বা বড় মানসিকতা কোনটিরই পরিচয় দিতে পারেননি।

৮৪ সালে শফিক রেহমান যখন সাপ্তাহিক ‘যায় যায় দিন’ বের করেন, তখন দেশে এরশাদের স্বৈরশাসন। পুরো এরশাদ আমল জুড়ে এ সাপ্তাহিকের ব্যাপক কদর ছিল। রসালো মিলা চরিত্র ছিল হট কেক। এরশাদের বান্ধবীদের পর্দার অন্তর্রাল থেকে গল্পোচ্ছলে প্রায়ই বের করে আনতেন মিলা।

একবার দৈনিক ইত্তেফাকের মালিকানা বিরোধে খুনোখুনি নিয়ে “হায় হোসেন হায় হোসেন” শিরোনামে কাভার স্টোরী করেন সাপ্তাহিকটি।

বঙ্গবন্ধুর খুনী ফারুখ-রশীদকে নিয়ে এক চাঞ্চল্যকার লীড নিউজ করে সাহসিকতার পরিচয় দেয় ‘যায় যায় দিন।’ সাপ্তাহিকটি পরে দৈনিকে রুপান্তরিত হয়। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের সাথে ঘাটাঘাটির অভিযোগে এক পর্যায়ে শফিক রেহমানকে ওই পত্রিকা থেকে বিতাড়িত করা হয়।

তারপর মালিকানা পরিবর্তন। অর্থনৈতিক সংকটে ছাঁটাই, ঝাটাই। সবশেষে, ‘যায় যায় দিন’ এখন উপজেলাজেলায় ভিখারী সাংবাদকর্মী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।

আর কদিন পর পত্রিকার ১৫ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে দেশের জেলা উপজেলা, নগর, মহানগর জুড়ে সংবাদদাতা ও প্রতিনিধিদের রাস্তায় নামানো হয়েছে ডিসপ্লে বিজ্ঞাপন কালেকশনে। ৩০% কমিশনের লোভে স্থানীয় প্রতিনিধিরা সীসার থাল নিয়ে মিসকিনের মতো চষে বেড়াচ্ছেন।

যেসব উপজেলায় সংবাদাদাতা নেই, সেসব উপজেলায় অতিসত্বর নিয়োগের ব্যবস্থা হচ্ছে। আমার নিজ উপজেলায় সংবাদদাতা নিয়োগে শুধু পরিচয়পত্র প্রদানের বিপরীতে, এক কলেজ প্রভাষককে, দশ হাজার টাকা নগদ বিজ্ঞাপনের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। ইউপি চেয়ারম্যানসহ দুর্নীতিবাজদের চাপে ফেলে, কিভাবে নগদ ডিসপ্লে বিজ্ঞাপন কালেকশন করতে হয় সে ধান্ধাবাজির রাস্তাও বাতলে দেয়া হয়।

করোনাকালে প্রিন্ট মিডিয়া হাউজের দুর্দশা চরমে। সার্কুলশন কমছে। বিজ্ঞাপন কমছে। বকেয়া বিজ্ঞাপনের টাকা মিলছেনা। এর মধ্যে নতুন মিডিয়া ও গজিয়ে উঠছে। অনেক মালিক লোকসান দিয়ে হাউজ চালাতে চাচ্ছেন না। তাই ছাটাই বা বেতনভাতা কমাচ্ছেন।

দৈনিক দেশতথ্য পত্রিকার মাধ্যমে বলতে চাই কোনো কোনো হাউজ কর্ণধাররা স্টাফদের করেধরে খাবার পরামর্শ বা মন্ত্রণা দিচ্ছেন। হাতেগোনা বাদে সবকটিই এখন করেধরে খাবার নীতি ফলো করায় দেশজুড়ে ভিখারী ও চাঁদাবাজ সংবাদকর্মী পয়দা করছে। তাই দিন যায় সাংঘাতিক মিডিয়া আসে। দিন যায় সাংঘাতিক সাম্বাদিক আসে। এভাবে দিন যায়। দিন আসে। কিন্তু সুসাংবাদিকতার সুদিন আসেনা।