উপজেলা পর্যায়ের ধান-চালের এই ব্যাবসায়ী ব্যবসা নয় রাজনীতি করেই হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক।
বিশেষ প্রতিনিধি নওগাঁ থেকে ফিরে: খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দূর্নীতি করে কোটিপতি হয়েছেন একথা বলা ঠিক হবেনা। তবে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ নয় বটগাছ হয়েছেন। দূর্নীতি অনিয়ম না করে যদি বিস্তর টাকা কামানোর সঠিক উত্তর তিনি যদি দিতে পারেন তবে তো বলতেই হবে তিনি ধোয়া তুলসী পাতা। আর তা না পারলে কি বলা যাবে তা তো বলবে অন্য কোন সরকারী সংস্থা। চিলের পেছনে না দৌড়ে দেখা যাক হলফ নামার সাথে কোথায় রয়েছে অসামঞ্জস্য।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেয় হলফনামায় কৃষিখাত থেকে বাৎসরিক আয় দেখান ৩০ হাজার টাকা। কৃষি জমির পরিমান দেখান লিজসহ ২৩ বিঘা। ব্যবসা থেকে আড়াই লাখ টাকা। শেয়ার সঞ্চয়পত্র / ব্যাংক আমানত (এফডিআর) দেখান ৪৯ লাখ টাকা। নিজনামে ব্যাংকে নগদ টাকা দেখান ২১ লাখ ৪১ হাজার ৮০৫ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থ ছিলো ১০ লাখ ৫০০ টাকা। পোস্টাল সেভিং, সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরণের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৩৯ লাখ টাকা। গাড়ী ছিলো দুটি। একটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অপরটি করমুক্ত ৪১ লাখ ৬৯ হাজার টাকার। বিয়ে সূত্রে পেয়েছেন ১২ ভরি সোনা। এই হলফনাফায় তিনি স্বাক্ষর করেন ২ ডিসেম্বর ২০১৩ ইং সালে।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হলফনামায় কৃষিখাত থেকে বাৎসরিক আয় দেখান ৩৫ হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত (এফডিআর) দেখান ১ কোটি ৮৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। নিজনামে ব্যাংকে নগদ টাকা দেখান ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থ ছিলো ২৪ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা। পোস্টাল সেভিং, সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরণের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৭৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৩ টাকা। এই নির্বাচনের সময় মাত্র একটি গাড়ীর তথ্য হলফনামায় তুলে ধরেন।
হলফনামা মতে গাড়ীটির মূল্য ধরা হয়েছে ৬৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৪২ টাকা। গত দুই সংসদ নির্বাচনে ১২ ভরি সোনাই রয়ে গেছে। জমিও লিজসহ ২৩ বিঘায় রয়ে গেছে। এছাড়া ১১ কাঠার একটি অকৃষি জমির কথা বলা হয়েছে যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩২ টাকা।
তবে ২০১৩ সালের হলফনামায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক নওগাঁ শাখা থেকে সিসি ঋণ দেখান ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪৮ টাকা। পরের নির্বাচনে তিনি এই ঋণটি সমন্বয় দেখান। ২০১৮ সালের হলকনামায় তিনি ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানি ভাতা পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। আয়ের উৎসে অন্যান্য/এফডিআর থেকে প্রাপ্ত সুদ হিসেবে দেখান ৪ লাখ ১০ হাজার ৫০৯ টাকা। এর আগের নির্বাচনের হলফনামায় সেটা দেখানো হয়নি। ফ্রিজ একটি, ফ্যান ৩টি, খাট ২টি, ড্রেসিং টেবিল ১টি, ডাইনিং টেবিল ১টি দেখানো হলেও এসির হিসাব তুলে ধরা হয়নি।
এই দুটি হলফ নামার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার দেয় হলফনামার হিসেবেই রয়েছে বিস্তর ফারাক। এক সংসদ নির্বাচন থেকে অপর সংসদ নির্বাচনের মধ্যের সময়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র এই কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। দুই নির্বাচনের হলফনামা দৃশ্যত হলেও অদৃশ্য সম্পদ কত আছে সে বিষয়ে তার লোকজন কোন মুখ খুলছে না। তার নির্বাচনী এলাকার সাধারণ ভোটারদের কাছে এই বিষয়ে কথা বলতে গেলেও কেউ সাক্ষাতকারও দিতে রাজী হয়না।
রাজী না হওয়ার সঙ্গত কারনও রয়েছে। নিয়ামতপুরের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল খাদ্যমন্ত্রীর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা। তিনিই এগুলো দেখাশোনা করেন। তিনি জানতে পারলে নির্যাতন করা হবে। এই নির্যাতনের ভয়ে কেউ মুখ খুলছেনা। তারা জানান, দখল টেন্ডার ম্যানেজ জমি বেচাকেনা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে মনা মজুমদারের বিরুদ্ধে।
আরো জানা যায়, তিনি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুর বলদাইঘাট গ্রামের কামিনী কুমার মজমুদারের পুত্র। তার বাবা ছিলেন শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিলো না। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে নওগাঁর নিয়ামতপুরে যেতো হতো। যানবাহন চলাচল উপযোগীঢ রাস্তা না থাকায় সাইকেল ঘোড়াগাড়ী গরুর গাড়ী বা পায়ে হাঁটাই ছিল সেখানে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। উপজেলার অধিকাংশ মানুষের কর্ম ছিলো কৃষিকাজ। কৃষির সাথেই জড়িত বলে খাদ্যমন্ত্রী সাধনা চন্দ্রের পিতা মাস্টারীর সাথে ধান চালের ব্যাবসা করতেন।
সাধন চন্দ্র মজুমদার উপজেলা পর্যায়ের ধান-চালের ব্যাবসায়ী। ব্যবসা নয় রাজনীতি করেই তিনি হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। তিনি যখন ব্যবসায়ী ছিলেন তখন চলতেন পায়ে হেঁটে। এখন চলেন ৬৪ লাখ টাকা দামের গাড়ীতে। আগে তার কোন পাইক পেয়াদা ছিলনা। এখন তার সাথে রয়েছে ডজন খানেক পাইক পেয়াদা। ব্যাংকের মজুদও বিপুল। রাজনীতিকে পুঁজি করে তিনি অঢেল সম্পদ হাতিয়েছেন। অনিয়ম করেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। এমনটিই এলাকার নিন্দুকেরা বলাবলি করে।
পোরশা সাপাহার ও নিয়ামতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-১ আসন। এর আগে এই আসন থেকে আরো দুবার নির্বাচন করে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন।
সে কথা যাই হোকনা কেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় কান পাতলে এই কথাই শোনা যায় স্কুল মাস্টারের ছেলে ও ধান ব্যবসায়ি সাধন চন্দ্র মজুমদারের এত টাকা ও সম্পদ পেল কেমন করে। এর উত্তরে অনেকেই বলেন, ১/১১ এর আর্শীবাদে তিনি কোটিপতি হয়ে সব কিছুই পেয়েছেন।
এলাকায় আরো জনশ্রুতি আছে বেসরকারি নিয়োগ বাণিজ্য স্কুলে নিয়োগ বাণিজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য জায়গা জমির কেনাবেচা সরকারি কাজের ঠিকাদারি কমিশন বাণিজ্য তাকে এমন সম্পদ গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। নামে বেনামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পদও গড়েছেন। আছে কালো টাকাও। কিন্তু সেই কালো টাকা কোথায়। লুকিয়ে রেখেছেন তা কেউ জানেননা। জানে শুধু পরিবারের সদস্যরা।
পোরশা, নিয়ামতপুর ও সাপাহার উপজেলা সদরের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, খাদ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা হলেও তিনি এলাকায় নিয়মিত যাননা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে তিনি জেলা পর্যায়েই থাকেন।
তাই এলাকার মানুষের অভাব, অনাটন, দাবী দাওয়া তিনি শোনেন না। নিজের সুবিধামত তিনি এলাকায় আসেন। আর নির্বাচন কাছে এলে তাকে এলাকায় দেখা যায়। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ভাই ও তার সিন্ডিকেট সদস্যরা এলাকায় এলাকায় টহল দিয়ে থাকে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নিজস্ব সিন্ডিকেট দিয়ে তার নির্বাচনী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। ভোটাররা ভোট দিয়েছিলো উন্নয়নের আশায় কিন্তু এখন সে সব গুড়েবালি। খাদ্যমন্ত্রী নানা অনিয়ম করে নিজ এলাকায় এখন বিষফোড়া। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, তাদেরকে মূল্যায়ন না করে মন্ত্রী ভাইলীগ ও সিন্ডিকেট লীগ তৈরি করেছেন।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//জুন ২১,২০২৩//

Discussion about this post