আটটি কূপের ছয়টি থেকে দিনে ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে
২০২৪ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন, ওয়ার্কওভার (সংস্কার) করে প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়াতে গত বছর আগস্টে পরিকল্পনা করেছিল সরকার। এখন পর্যন্ত আটটি কূপের কাজ শেষে ছয়টি থেকে দিনে ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। দুটি কূপের কাজ চলছে এবং বাকিগুলোর কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
সব মিলিয়ে সিলেট গ্যাস ফিল্ড সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেকটা এগিয়ে আছে। বাপেক্স মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে আর বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডসের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।
পরিকল্পনাধীন ৪৬টি কূপের মধ্যে ১৫টি উন্নয়ন কূপ, ১৬টি ওয়ার্কওভার কূপ ও ১৫টি অনুসন্ধান কূপ। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন কূপকে উন্নয়ন কূপ, পুরনো গ্যাসক্ষেত্র সংস্কারের মাধ্যমে গ্যাস পাওয়া গেলে সেটিকে ওয়ার্কওভার কূপ ও সম্পূর্ণ নতুনভাবে সন্ধানের জন্য কূপ করা হলে তাকে অনুসন্ধান কূপ বলা হয়।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফএল)।
সূত্রমতে, বাপেক্সের ১৯টি কূপের মধ্যে পাঁচটির খনন শেষে তিনটিতে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। এর দুটি অনুসন্ধান কূপ (টবগী-১ ও ইলিশা-১) এবং একটি উন্নয়ন কূপ (ভোলা নর্থ-২)। উৎপাদিত গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে প্রসেস প্ল্যান্ট সংগ্রহ ও স্থাপনের জন্য দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে। শ্রীকাইল নর্থ-১ ও শরীয়তপুর-১-এ দুটি পৃথক কূপ খননের পরও গ্যাস পাওয়া যায়নি।
বাপেক্সের কর্মকর্তারা মনে করছেন, খননের ফলে যে তথ্য পাওয়া গেছে ভবিষ্যতে ওই এলাকায় অনুসন্ধানে তা সহায়ক হবে। বাকি ১৪টির মধ্যে শাহবাজপুরের পাঁচটি কূপ খনন করবে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম। এখন ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে। এটা শেষ করতে অন্তত দুই মাস লাগবে। আরও তিনটি কূপে (শ্রীকাইল ডিপ-১, মোবারকপুর ডিপ-১ ও ফেঞ্জুগঞ্জ-১) ডিপ ড্রিলিং বা গভীর খননের প্রয়োজন হওয়ায় তা ঠিকাদারের মাধ্যমে করানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বাপেক্স। এজন্য ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে।
এসব কূপে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মিটার গভীরে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। বাপেক্সের রিগ দিয়ে ৫২০০ থেকে ৫৪০০ মিটার পর্যন্ত খনন করা যায়। পরিকল্পনাধীন আরও ছয়টি কূপ রয়েছে যেগুলো বাপেক্স নিজেই খনন ও অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে। সুন্দলপুর, শ্রীকাইল, জকিগঞ্জ ও জামালপুরে চারটি কূপ খননের জন্য ডিপিপি তৈরি করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি দুটির ডিপিপি আগামী মাসে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বাপেক্স।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ জানতে একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েবকে ফোন দিয়ে এবং তার কার্যালয়ে গিয়েও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির দুজন কর্মকর্তা জানান, কাজ শুরুর আগে অনুমোদন পেতে দেরি হওয়া ও কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অলসতাও দায়ী।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির ১৩টি কূপের কাজ শেষ হবে। তখন দৈনিক গ্যাস মিলবে ১৭৩ মিলিয়ন ঘনফুট। এক বছরে মাত্র একটি কূপের ওয়ার্কওভার (তিতাস-২৪) শেষে মাত্র সাড়ে ৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. আবদুস সুলতান বলেন, ‘বাকি ১২টি কূপের ডিপিপি তৈরি করে গত মাসে জালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের পর দরপত্র আহ্বানের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা হলে মূল কাজ শুরু হবে। আশা করছি, আগামী বছরের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে।’
সূত্র জানায়, আগামী বছরের মধ্যে সব কূপের কাজ শেষ করা যাবে না। বড়জোর পাঁচ থেকে ছয়টা কূপের কাজ হতে পারে। ডিপিপি তৈরিতে দেরির কারণেই কাজ পিছিয়ে গেছে।
বাপেক্স ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির তুলনায় সিলেট গ্যাস ফিল্ডের অগ্রগতি ভালো। তারা সাতটি ওয়ার্কওভার কূপ, ছয়টি অনুসন্ধান কূপ ও একটি উন্নয়ন কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে।
কাজের অগ্রগতির বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আশা করছি আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ১৪টি কূপের কাজ শেষে দৈনিক ১৬৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাব। ইতিমধ্যে বিয়ানীবাজার-১ কূপের ওয়ার্কওভার শেষে সেখান থেকে দৈনিক ৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। কৈলাশটিলা-২, সিলেট-৭, রশিদপুর-২ ও রশিদপুর-৫ ওয়ার্কওভারের অনুমোদন হয়েছে। কৈলাশটিলা-২ দিয়ে শুরু করেছি। আগামী দুই মাসের মধ্যে এ কূপ থেকে গ্যাস পাওয়ার আশা রয়েছে। এ কূপের পাইপলাইন নির্মাণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। গ্যাস পেলেই সরাসরি জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হবে। চারটি কূপ থেকে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার আশা রয়েছে। গত ২৪ জুন সিলেট-১০-এ অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়েছে। কূপটি ৩৩০০ মিটার গভীরে খনন করতে হবে। প্রায় ১২৭০ মিটার খনন হয়েছে। কৈলাশটিলা-৮-এ অনুসন্ধান কূপ খননের কাজ শুরু হবে আগামী সেপ্টেম্বরে’ বলেন মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘রশিদপুর-৯-এর খননকাজ শেষ হয়েছে। এ গ্যাস সরবরাহ করতে পাইপলাইনের কাজ চলছে। এখান থেকে প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। আগামী দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে কৈলাশটিলা-২ ও রশিদপুর-৯ কূপ থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’
সূত্রমতে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বাকি চারটি (রশিদপুর-১১, রশিদপুর-১৩, ডুপিটিলা-১, কৈলাশটিলা-৯) অনুসন্ধান কূপ ও একটি (সিলেট-১১) উন্নয়ন কূপ খনন করবে প্রতিষ্ঠানটি। ডিপিপি পেট্রোবাংলার মাধ্যমে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন শেষে দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ শুরু হবে।
’এখন দেশি কূপ থেকে দৈনিক প্রায় ২১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। আমদানিকৃত উচ্চমূল্যের এলএনজি থেকে আরও প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। এরপরও ঘাটতি থাকছে প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাস সংকটের কারণে এক যুগ ধরে বাসাবাড়িতে নতুন সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, দেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অনুসন্ধানে গাফিলতি রয়েছে। কারণ আমদানিতে ঝোঁক বেশি। সম্প্রতি কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আনার চুক্তি হয়েছে। মালয়েশিয়া ও অন্য দেশ থেকেও এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি খোলা বাজার থেকে চড়া দামে কেনা হচ্ছে এলএনজি।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, ‘সরকারের যে পরিকল্পনা তা আগামী বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। যেসব ওয়ার্কওভার ও উন্নয়ন কূপ খননের কথা রয়েছে তার অনেকগুলো হয়তো শেষ হবে। কিন্তু অনুসন্ধান কূপ করা সম্ভব নয়; কারণ এগুলো সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় করতে হয়। প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণেই লাগে এক-দুই বছর। আগামী বছর ১২টি অনুসন্ধান কূপ করার কথা। অথচ বাংলাদেশ বছরে এ ধরনের কূপ খনন করে সাধারণত এক থেকে তিনটি। এত কূপ কীভাবে খনন সম্ভব তার কোনো নির্দেশনা নেই। আউটসোর্সিং করেও তো সম্ভব নয়। হাস্যকর ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের জালানি আমদানির ঝোঁক নিয়ে যে সমালোচনা হয় তাতে রাশ টানতেই সাময়িকভাবে এসব করা হয়। এতে ব্যর্থ হলে সরকার বলবে, ‘আমরা দেশি গ্যাস অনুসন্ধানের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কিন্তু দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তা করতে পারল না’। তখন আবার আমদানি করবে। আগেও পাঁচ বছরের মধ্যে ১০৮টি কূপ খননের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে। আমরাও খুশি হয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন সব ছাইভস্ম হয়ে গেল। বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে তৎপর হওয়া দরকার। এতদিনে যদি বছরে পাঁচটা কূপও খনন করা যেত তাহলে গ্যাসের এত সংকট হতো না। এখনো সে সুযোগ রয়েছে।
দৈনিক দেশতথ্য//এস//

Discussion about this post