খাবার থাকার পরও রান্না করতে না পারায় অনাহারে মারা গেছেন শিল্পি আশরাফ। কবরস্থান তলিয়ে যাওয়ায় ছয়দিন পর তাকে সমাহিত করা হয়েছে।
বন্যা কবলিত সুনামগঞ্জের জারী গানের শিল্পী আশরাফ আলীর করুন মৃত্যুর কথা ভুলতে পারছে না ওই এলাকার মানুষ। তিনি খাবার না পেয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নৌকা না পাওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেয়া যায়নি। কবর স্থান বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তাকে দাফন করা যায়নি। তার লাশ কাফন করার পর পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে কাঠের কফিনে রাখা হয়েছিল ছয় দিন।
১৮ জুন শনিবার বাদ জোহর লাশ নৌকায় রেখে যানাজা দেওয়া হয়। কবরস্থান থেকে বন্যার পানি কিছুটা সরে গেরে ২২ জুন বুধবার লাশটি দাফন করা হয়। এসময় কোস্টগার্ডের সুনামগঞ্জ অঞ্চলের অধিনায়ক লে: কর্ণেল সাব্বির ও ইউপি সদস্য মোঃ গিয়াস উদ্দিন এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
মরহুম আশরাফ আলী’র জেষ্ট কন্যা মোছাঃ তানজিনা বেগম রোকশানা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত বাউল শিল্পী ও সুরমা ইউনিয়নের সংরক্ষিত ১,২,৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যা। তিনি বলেন এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি আমরা। বসতভিটে ধান চাল কাপড় চোপড় হাড়িপাতিলসহ আমাদের সবকিছুই নিয়ে গেছে বন্যার পানি। আশ্রয় কেন্দ্রের আশ্রয়স্থলে এসে বাবাকেও হারিয়েছি। বাবার মরদেহ ৬টা দিন পাহারা দিয়েছি।
এই জারী শিল্পির বাড়ি সুনামগঞ্জের ইব্রাহিমপুরের পশ্চিমপাড়ায়। প্রতিবছর মহরম মাসে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণে নিজ বাড়ীতে জারী গানের আসর বসাত। জারী গান ও পুথি পাঠ করার পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন বাউল শিল্পীদের গান পরিবেশন করাতেন। একজন সহজ সরল শান্ত স্বভাবের মানুষ হিসেবে এলাকায় তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ২ পুত্র ও ৫ কন্যার জনক তিনি।
সুরমা ও ধোপাজান নদীর পাড়ের নিচু জমিতে ঘর করে দিন যাপন করতেন। ঘরে ১০ বস্তা ধান, এক বস্তা চাল ও লাকড়ীসহ জ্বালানী উপকরণ ছিল। বন্যার পানিতে (১৫ জুন বুধবার) তার ঘরে মধ্যে মুখ সমান পানি হয়ে যায়। ১৬ জুন বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ইব্রাহিমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে স্বপরিবারে আশ্রয় নেন।
ঘরে খাবার থাকার পরও চুলা ও লাকড়ী না থাকায় তারা রান্না করতে পারেনি। তাই বৃহস্পতিবার দিনভর পরিবার নিয়ে উপবাসে ছিলেন। ১৭ জুন আশ্রয়কেন্দ্রে কোন খাবার জুটেনি তাদের। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভারী বৃষ্টিপাত ও প্রবল পাহাড়ী ঢলের কারণে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার কোন বাহন পায়া যায়নি। এমতাবস্থায় ১৭ জুন শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় তার মৃত্যু হয়।
একই গ্রামের সাজু মিয়া নামে একজন ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ আসার পথে মারা যান। ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বন্যার কারণে আটকে যায় তাদের গাড়ি। সেখানেই তিনি মারা যান। সাজু মিয়ার মেয়েজামাই ছালাতুল নৌকায় করে শ্বশুরের লাশ গ্রামে নিয়ে আসেন। বাক্সবন্দি করে সাজু মিয়া ও আশরাফ আলীর লাশ রাখা হয়। বুধবার বিকেল তার লাশ দাফন করা হয়েছে।
গ্রামের বিশিষ্ট সালিশীজন মহরম আলী ও গ্রাম পুলিশ আসকর আলী বলেন, এমন ভয়াবহ বন্যা আমরা কেউ জীবনে দেখিনি। মৃত আশরাফ আলীর মেয়ে রেজিয়া বেগম বলেন, ঘরে পানি ওঠায় বাবার পাশাপাশি আমি ও আমার স্বামী সন্তানদেরকে নিয়ে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। স্কুলে আশ্রয় থাকাবস্থায় আব্বা মারা যান। কোনো উপায় না পেয়ে আমরা দু দুটি পরিবার এখন বড় বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। সেখানে আমরা ৩টি পরিবার একসাথে বসবাস করছি। এখন পর্যন্ত আমার ও আব্বার ভিটার পানি সরেনি। তাই আমরা কখন বন্যার পানি মুক্ত হবো সেই প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছি।
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজা বলেন, আশরাফ আলী ভাইয়ের আশ্রয় কেন্দ্রে মারা যাওয়ার ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত ও বড়ই হৃদয় বিদারক। অনাকাঙ্কিত এই মৃত্যু আমাদেরকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। ভবিষতে আমাদের গ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তাঘাট ও কবরস্থানকে উচু করাসহ মেরামত ও সংস্কারের উদ্যোগ নেব।
ইব্রাহিমপুর জামে মসজিদের ইমাম ও মুসল্লীয়ানরা বলেন, দুনিয়াতে হয়তো তিনি শহীদ এর পরিচিতি পাবেননা। তবে দুর্যোগকালীন সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয়রত অবস্থায় মৃত্যুবরন করায় তিনি পরকালে শহীদের মর্যাদা পাবেন। গ্রামের কৃতিসন্তান বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রযোজক সংগীত শিল্পী মোঃ আপ্তাব মিয়া বলেন, আধ্যাত্মিক জগতের একজন নিভৃতচারী প্রচারভিমুখ মানুষ ছিলেন জারী গানের শিল্পী আশরাফ আলী।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//জুন ২৩,২০২২//