মাত্র ২৩ বছরের যুবক সুবেল হোসেন। উচ্চতা ৮ ফুট। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে অস্বাভাবিকভাবে তার উচ্চতা বেড়েই চলেছে। ব্রেন টিউমার, হরমোনের সমস্যাসহ নানা রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। শরীরে শক্তি পান না, পা বাঁকা হয়ে ফুলে গেছে। দিন দিন হেঁটে চলার শক্তিটুকুও হারিয়ে যাচ্ছে। টাকার অভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারছে না পরিবার। সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে সুবেল হোসেনের পরিবার।
সুবেল হোসেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রিফাইতপুর ইউনিয়নের সংগ্রামপুর গ্রামের কৃষক ইউনুচ আলীর ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সুবেল দ্বিতীয়। শারীরিক সমস্যার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার।
সুবেল বলেন, “আমার উচ্চতা ৮ ফুট। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমি ভালোই ছিলাম। অন্যসব মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন ছিল আমার। ৯ বছর আগে আমার রোগটি ধরা পড়ে। গত চার বছর আগে আমার উচ্চতা আরও বেশি বেড়ে যায়। এছাড়া মাথায় টিউমার ও পায়ের সমস্যার কারণে চলাফেরা করতে পারি না। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে-বসে থাকতে হয়। বাড়ির বাইরে বের হই না। মাথা ও পায়ে যন্ত্রণা করে। দিন দিন উচ্চতা বেড়েই চলেছে। খাটের তুলনায় দেহ বড় হওয়ার শুতে সমস্যা হয়। ঘর থেকে বাইরে বের হতে গেলে দরজা ও ঘরের ছাউনির সঙ্গে মাথা বেধে যায়। অনেক সমস্যা ও কষ্টের মধ্যে আছি। আগে আমি স্কুলে যেতাম, মাঠে কাজ করতাম। স্বাভাবিক মানুষের মতো সব কিছু করতে পারতাম। এখন আর কিছুই করতে পারি না। “
তিনি আরও বলেন, “আমার ব্রেন টিউমার ধরা পড়ার পরে ঢাকার পিজি হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন রাজশাহীর চিকিৎসকরা। কিন্তু অর্থের অভাবে সেখানে যাওয়া হয়নি, চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। আমরা গরিব মানুষ। আমার পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা খরচ বহন করা সম্ভব না। আমার কষ্ট সরকারের চোখে পড়ে না। বারবার সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েও লাভ হয়নি। এখানকার এমপি, ইউএনও কেউই আমার খোঁজ নেননি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য সহযোগিতা করা হয়নি এখন পর্যন্ত। তবে কষ্টের বিষয় হচ্ছে- সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েও কেউ যোগাযোগ করেনি, সহযোগিতা করেনি। সবাই শুধু আশ্বাস দেয়, কেউ সহযোগিতা করে না। সরকারের কাছে আমি টাকা-চাল চাই না, চিকিৎসা চাই।”
সুবেলের মা পান্না খাতুন বলেন, আমার ছেলের অস্বাভাবিক কষ্টের জীবন। ঠিকমতো কিছুই করতে পারে না। চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়। দুপুর ১টার সময় একটু খায়, বিকেল ৫টায় গোসল করে। আস্তে আস্তে বড় হতে হতে আমার ছেলে এমন হয়ে গেল। আগে মাঠে কৃষি কাজ করতে পারতো, সবই পারতো স্বাভাবিক মানুষের মতো। ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে আমার ছেলের এ সমস্যা শুরু হয়। এখন ঘরের ছাউনির সমান লম্বা হয়ে গেছে। পায়ে ও মাথায় সমস্যা। যতই দিন যাচ্ছে, ততই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ৮ ফুটের বেশি লম্বা এখন। তার চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।
তিনি বলেন, কেউ কোনো দিন কিছুই সাহায্য করেনি, কিছু দেয়নি। তবে কিছু মানুষ আমাদের মিথ্যা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। পরে তারা কোনো সহযোগিতাই করেনি। অর্থের অভাবে চিকিৎসা বন্ধ, আপনারা আমার ছেলেকে বাঁচান।
সুবেলের বাবা ইউনুচ আলী বলেন, অস্বাভাবিকভাবে আমার ছেলে দিন দিন লম্বা হয়ে যাচ্ছে। তার পায়ে সমস্যা, পা বাঁকা হয়ে গেছে, ফুলে যায়। এ ছাড়া শরীরের নানা স্থানে ফোলা রোগ দেখা দিয়েছে। সঙ্গে ব্রেন টিউমারও আছে। লাঠি বা কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না। ঘরে ঢুকতে ও বের হতে সমস্যায় পড়তে হয়।
তিনি বলেন, ১৪ বছর বয়সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক দিন সকালে ছেলেকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরে গিয়েছিলাম এবং এক জোড়া জুতা কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিকেলে সেই জুতার মধ্যে পা ঢোকে না। এভাবে দেহের উচ্চতা ও পা দিন দিন অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এরপর সুবেলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বেশ কিছু দিন ভর্তি রেখে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন যে, সুবেলের ব্রেন টিউমার হয়েছে। তা ছাড়া হরমোনের কারণে তার শরীরে অস্বাভাবিক উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরপর টাকার অভাবে চিকিৎসা না করেই ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি। আমি সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করছি। এখন পর্যন্ত আমাদের কেউ সহযোগিতা করেনি।
রিফাইতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রশিদ বাবলু বলেন, সুবেল দেশের সবচেয়ে লম্বা মানুষ। সে অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করা হবে।
দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল জব্বার বলেন, সুবেল হোসেনের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হবে। সুবেলের জন্য দোয়া রইল, তার সুস্থতা কামনা করি।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশের দীর্ঘ মানব কক্সবাজারের রামু উপজেলার জিন্নাত আলীর মৃত্যু হয়। তার উচ্চতা ছিল ৮ ফুট ৫ ইঞ্চি। তিনি মারা যাওয়ার পর দৌলতপুর উপজেলার সুবেল হোসেনকে দেশের সবচেয়ে লম্বা মানুষ হিসেবে দাবি করা হয়।

Discussion about this post