Print Date & Time : 7 May 2025 Wednesday 1:44 am

সেবার মান বেড়েছে মিরপুর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর চাপ সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন ডাক্তার কর্মচারীরা। তবে আগের থেকে রোগীর চাপ বাড়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।।

গতকাল সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ৫০ শয্যার হাসপাতালটির বহিঃবিভাগে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশো রোগী। জরুরি বিভাগেও ভীড় করছেন কাটা-ছেঁড়ার রোগীদের স্বজন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক মাস ধরে নিয়মিত জ্বর,সর্দি,কাশিসহ বিভিন্ন ফ্লুজনিত রোগীর অস্বাভাবিক চাপ দেখা দিয়েছে। বহি:র্বিভাগ ও শয্যায় অতিরিক্ত রোগীর চাপ নিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে বহির্বিভাগে কোনো কোনো চিকিৎসককে ৪ ঘণ্টায় দুই শতাধিক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিতে হয়। এ অবস্থায় জেলার দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটিতে দ্রুত বহির্বিভাগের চিকিৎসকের পদায়ন জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয়রা বলছে, মিরপুর উপজেলার প্রায় সোয়া তিন লাখ মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম অবহেলার কারণে ভোগান্তিতে ছিলেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। সামান্য অসুস্থ হলেও রোগীদের কুষ্টিয়া জেলা সদর হাসপাতাল যেতে হতো।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: পিযুষ কুমার সাহা যোগদানের পর দুই বছরে হাসপাতালের চিত্র পাল্টে দিয়েছেন। এখন ভালো সেবা পাওয়ায় এ উপজেলা ছাড়াও আশপাশের দৌলতপুর এবং গাংনী উপজেলার সীমানার রোগী আসছে এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

হাসপাতাল সুত্র জানায়, ২০২০ সালের হিসেবে বহির্বিভাগে ৩৭ হাজার ৬৩২ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। একই সময়ে অন্তর্বিভাগে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪ হাজার ৫৩৪ এবং জরুরি বিভাগে ৯ হাজার ৭২৩ জন।

২০২১ সালে বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৫৬ হাজার ২৩৯ জন। একই সময়ে অন্ত:র্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ১১২ এবং জরুরি বিভাগে ১২ হাজার ৮৮৪ জন।

২০২২ সালে বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৭৭ হাজার ৯৯১ জন। একই সময়ে অন্ত:র্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮ হাজার ৩৫৪ এবং জরুরি বিভাগে ৯ হাজার ৯১২ জন।

২০২০ সালে এ হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ২৩৪ জন, ২০২১ সালে ২৯৪ জন এবং ২০২২ সালে ২৭৪জন এবং সম্প্রতি, সপ্তাহে সিজার হয়েছে ৪১ জন প্রসূতির।
এদিকে, চিকিৎসক না থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় দুই যুগ বন্ধ ছিল সিজারিয়ানসহ বড় ধরনের অপারেশন। এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশন না হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। বাধ্য হয়ে তাদের যেতে হয় বেসরকারি ক্লিনিকে। অবশেষে মানুষের কষ্ট লাঘব হতে এ বছরের ফেব্রুয়ারীতে চালু হয় সিজারিয়ান অপারেশন।

এদিকে হাসপাতালের রাজস্ব আয়ও বেড়েছে। ২০২০ সালে রাজস্ব আয় ছিল ৮ লাখ ১১ হাজার ৩৬৫ টাকা। ২০২১ সালে রাজস্ব আয় দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯৯ হাজার ৭৪৯ টাকা। এবং ২০২২ সালে রাজস্ব আয় দাঁড়ায় ১২ লাখ ১৫ হাজার ৪৬৭ টাকা। এছাড়াও এই ২০২৩ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত রাজস্ব আয় হয়েছে ৭ লাখ ৩৯৬ টাকা।

এছাড়াও রোগী বাড়ায় হাসপাতালটি ১০০ শয্যা উন্নীতকরণ এবং ভবন বাড়ানো জরুরি। সম্প্রতি, ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট সরবরাহ যথেষ্ট রয়েছে।

পরিষ্কার পরিছন্নতা কর্মী,স্টোর কিপার,অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার জরুরি। হাসপাতালে চিকিৎসক থাকার কথা ৩৪ জন, আছেন ১৯ জন। ৩০ জন নার্সের মধ্যে আছেন ২৯ জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৩১ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ১২টি পদে রয়েছে।

সবকিছুর পরও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও চিকিৎসা সেবার মানে ইতিমধ্যেই হাসপাতালটি তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে ঝকঝকে পরিবেশ। হাসপাতালে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে জরুরি বিভাগ। সুন্দর বিশ্রামাগার। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য তালিকা টানানো রয়েছে দেয়ালে এবং সীমানা প্রাচীরের ভিতরের চারপাশে রোপণ করা হয়েছে ফলদ-বনজ, ঔষধিসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। আগে যেখানে এই হাসপাতাল চত্বর গোচারনে পরিণত ছিলো আর বর্তমানে এসে হাসপাতাল চত্বর যেন একটা ছোটখাটো পার্কে পরিণত হয়েছে। রয়েছে কয়েক’শ ফুল ও ফলের গাছ। উপজেলার কাতলামারী থেকে হাসপাতালে স্ত্রীকে ভর্তি করেছিলেন আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, “আগের চেয়ে এখনকার চিকিৎসক ও নার্সরা অনেক আন্তরিক। এখান থেকে ওষুধ দেয়াসহ যেকোনো সমস্যায় ডাকলে কাছে আসছে তারা”।

কালিতলা এলাকার মোবাশ্বের মিয়া জ্বর ও মাথা ব্যাথা সমস্যায় তার ভাইকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। তিনি বলেন,“আগে পরীক্ষার জন্য বাইরে যেতে হতো। এখন স্বল্প খরচে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা যাচ্ছে। আমরা তো আর ঢাকার বড় হাসপাতালে বেশী টাকায় চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষমতা নেই “।

সন্তান ডেলিভারির ব্যাথা নিয়ে আসমা খাতুন নামের এক রোগীর মা হাসপাতালে আনার পর নরমাল ডেলিভারিতে ছেলে শিশুর জন্ম হয়েছে। খুশিতে তার স্বামী বলেন, “ক্লিনিকে সিজার করাতে ২০ হাজার লাগতো। আমি রিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। এতো টাকা কেমনে দিতাম। এখানে বিনামূল্যে ডেলিভারি হয়েছে”।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: পিযুষ কুমার সাহা বলেন, “আমি এখানে যোগদানের পর মাননীয় সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু স্যারের পরিকল্পনা ও আমাদের বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় এবং মিরপুর উপজেরা পরিষদের চেয়ারম্যান কামারুল আরেফীন এর পরামর্শে স্বাস্থ্য মান বৃদ্ধির কাজ করছি। এতে সহকর্মী, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা,ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ সবাই সহযোগিতা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মিরপুর প্রত্যান্ত অঞ্চল হওয়ায় প্রতিদিন গড়ে ৬শ রোগী সেবা নিতে আসে। সেখানে আমরা সেবার মান বাড়াতে কাজ করলেও কিছু জনবল সংকট রয়ে গেছে।

আপ্রাণ চেষ্টা করে দীর্ঘদিন পর হলেও এই হাসপাতালেল সিজারিয়ান অপারেশনের ব্যবস্থা চালু করেছি। তবে অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক খন্ডকালীন পেয়েছি। পুরোপুরি অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক পেলে অপারেশনের জন্য আরও সহজ হতো। যে কারণে মানুষ এখনো কিছু সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইতিমধ্যেই আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি এটাও কাটিয়ে উঠতে পারবো”।

কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডাঃ এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “মফস্বলের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতে অনেক চিকিৎসকই কাজ করতে চান না। উল্টো পরিবেশ মিরপুরে। এই হাসপাতালে ডা: পিযুষ কুমার সাহা যোগদানের পর থেকে সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে বেড়েছে সেবার পরিধি। আমরাও সার্বক্ষনিক তদারকি করছি।

খালিদ সাইফুল // দৈনিক দেশতথ্য // ১৬ অক্টোবর ২০২৩