Print Date & Time : 21 April 2025 Monday 7:43 pm

স্বপ্নীল গণগ্রন্থাগার হাওড়ে আলোর বাতিঘর

অন্তরের আঁধারে আলোর প্রদীপ জ্বালাতে হলে বই একমাত্র সহায়ক। আর বইয়ের মহা আবাসস্থল হল গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরী। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সরকারী বা বেসরকারী গণগ্রন্থাগার। এ সমস্ত গ্রন্থাগারে মানুষের হাজার বছরের লিখিত অলিখিত সব ইতিহাস নীরবে ঘুমিয়ে আছে বুক সেলফের প্রতিটি তাকে, বইয়ের পাতায় পাতায়।
প্রন্থাগার হল কালের খেয়াঘাট। যেখান থেকে মানুষ সময়ের পাতায় ভ্রমন করে। প্রচীন শিলালিপি থেকে আধুনিক লিপির গ্রান্থিক স্থান হলো একেশটি গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরী। একটি গ্রন্থাগার মানব জীবনকে যেমন পাল্টে দেয়, তেমনি আত্মার খোরাকও যোগায়। তাই গ্রন্থাগারকে বলা হয় মানুষের শ্রেষ্ঠ আত্মীয়। যার সঙ্গে সব সময় ভাল সম্পর্ক থাকে। জ্ঞানচর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে এসব গহ্রন্থাগারের ভূমিকা অনন্য। গ্রন্থাগারকে তুলনা করা হয় জ্ঞানের মহা সমুদ্রের সঙ্গে। অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে সেতু বন্ধন তৈরী করে এই গ্রন্থাগার। আর তাই আকাম সংস্কৃতির এই যুগেও কিশোরগঞ্জের হাওড় উপজেলা, ভাটিররানী বলে খ্যাত অষ্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্রাচীন জনপদ কাস্তুল বাজারে প্রতিষ্ঠিত ”স্বপ্নীল গণগ্রন্থাগার” প্রায় দুই হাজার বই নিয়ে প্রত্যন্ত হাওরের বুকে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ গ্রন্থাগারটি ইতিমধ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক পৃথক ভাবে নিবন্ধিত হয়েছে। এ গ্রন্থাগারের রয়েছে ”স্বপ্নীল সাহিত্য প্রকাশন” নামে একটি নিজস্ব প্রকাশনা বিভাগ। এখান থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাতটি। এখানে কর্মরত রয়েছেন একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইব্রেরীয়ান ও একজন অফিস সহায়ক। এ গ্রন্থাগারে বছরে ২/৩ বার চিত্রাংকন, বইপাঠ ও রচনা প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। বিজয়ীদের প্রদান করা হয় সনদপত্রসহ পুরষ্কার। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসসহ উদযাপন করা হয় সকল জাতীয় দিবস। এ গ্রন্থাগারটি ২০২০ ও ২০২১ সালে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জেলা সরকারী গণগ্রন্থাগার কর্তৃক জেলার শ্রেষ্ঠ বেসরকারী গণগ্রন্থাগার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
সম্পূর্ণ ধুমপান মুক্ত এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে কবি মো. তৈয়ব আলী রচিত পবিত্র কোরআন শরীফের বাংলা কাব্যানুবাদ, তরজমাসহ পবিত্র কোরআন-হাদীস, মহাভারত, গীতা, বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ। ইতিহাস ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ভূগোল, ভ্রমন কাহিনী, মনিষীদের জীবনীগ্রন্থ, আইন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি।
এখানে চারটি বাংলা জাতীয় দৈনিক, একটি ইংরেজী জাতীয় দৈনিক, একটি বাংলা স্থানীয় দৈনিক, একটি ইংরেজী স্থানীয় দৈনিক, ভারত বিচিত্রা, দুইটি সাপ্তাহিক পত্রিকসহ সাহিত্য ও কৃষি ম্যাগাজিন নিয়মিত রাখা হয়। গ্রন্থাগারটি শনি থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য খোলা রাখা হয়। এখানে প্রতিদিন ২৫/৩০জন পাঠক-পাঠিকা নিয়মিত পত্র-পত্রিকাসহ বই পাঠে জ্ঞানের আলো নিতে আসেন।
গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলাম সাগর এ প্রতিনিধিকে জানান, গ্রন্থাগারটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজসেবা ও ভর্তুকিমূলক প্রতিষ্ঠান। বিগত অর্থ বছরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তৃক এ গ্রন্থাগারে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে। সরকারী অনুদান যা আসে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। তারপরও গ্রন্থাগারটিকে আধুকায়ন করার চেষ্টা চলছে।
স্বপ্নীল গণগ্রন্থাগার সম্পর্কে বাংলাদেশ বেসরকারী গণগ্রন্থাগার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম সিদ্দীক মুঠোফোনে এ প্রতিনিধিকে জানান, স্বপ্নীল গণগ্রন্থাগার দূর্গম হাওরে যেভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, আমার বিশ^াস যদি এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তবে একসময় এ গ্রন্থাগার কিশোরগঞ্জের অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগারে পরিণত হবে এবং হওরের প্রত্যন্ত ও নিভৃত পল্লীতে শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
হাওড় অঞ্চলবাসী ঢাকা এর সাধারণ সম্পাদক রোটারীয়ান কামরুল হাসান বাবু এ গ্রন্থাগার সম্পর্কে বলেন, পিছিয়ে থাকা জনপদে স্বপ্নীল গণগ্রন্থাগার আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করছে । হাওড়ের মানুষের মধ্যে পাঠ অভ্যাস তৈরীতে পাঠাগারটি বিশেষ ভুমিকা রেখে চলেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি সরকারী ও বেসরকারী ভাবে আরো সহায়তা পেলে জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষের জীবন পরিবর্তনে বড় ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
গ্রন্থাগারটি পরিদর্শনে এসে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আশরাফুল আলম বলেন, সুন্দর পরিবেশে অবস্থিত গ্রন্থাগারটি হাওড়ে পড়াশুনার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ গ্রন্থাগারটি সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা পেলে ভাটি এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ^াস।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সরকারী গণগ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক (লাইব্রেরিয়ান) আজিজুল হক সুমন এ প্রতিনিধিকে জানান, ”স্বপ্নীল” হাওড় উপজেলা অষ্টগ্রামের সর্ববৃহৎ গণগ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারটি হাওরবাসীর মেধা ও মননের বিকাশে দীর্ঘদিন দওে কাজ কওে যাচ্ছে। নতুন পাঠক সৃষ্টি, জ্ঞান বিতরণ, জনসচেতনতা তৈরী, প্রকাশনা, বিভিন্ন প্রতিযোগীতার আয়োজনসহ নানাবিধ ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে হাওড় অঞ্চলে আলোর বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে গ্রন্থাগারটি। সত্যিই, এ গ্রন্থাগারটি দুর্গম হাওড়ে যেভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে বই ও আত্মার সেতুবন্ধন তৈরী করে যাচ্ছে, সে বিবেচনায় স্বপ্নীল গণগ্রন্থাগারকে হাওড়ের বাতিঘর বলা যেতে পারে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. হারুন-অর-রশিদ এ প্রতিনিধিকে জানান, স্বপ্নীল গণগ্রন্থাগার হাওরাঞ্চলে বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে। এই এলাকার স্কুল ও কলেজ পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীসহ সাধারণ জনগণের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে শুরু থেকেই এটি কাজ করে যাচ্ছে। দূর্গম হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা বাস করে তাদের জ্ঞান বিকাশে এই গ্রন্থাগারটি যে অবদান রাখছে তা সত্যিই অনস্বীকার্য।

দৈনিক দেশতথ্য//এইচ/