Print Date & Time : 20 April 2025 Sunday 5:13 am

স্মৃতিচারণ: সুইডেনে ৭ মার্চ উদযাপন ও সুইডিস পত্রিকার মন্তব্য

গভীর রাতে টেলিফোন বেজে উঠল। সুইডেনে রাত তখন ৩টা হবে। এত রাতে টেলিফোন! রিসিভার না নেওয়া পর্যন্ত বুক ধড়ফড় করে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভার তুলে বললাম, হ্যালো…। ক্যাটরিনের গলা শোনা গেল। সে বললো দুঃখিত, রহমান! এখন যে তোমার ওখানে রাত ভুলে গিয়েছি। বললাম ব্যাপার কী? বলল, ডাল কি করে রান্না করতে হয় তা ভুলে গেছি। এজন্য তোমাকে ফোন করলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

টেলিফোন করেছে আমার এক আমেরিকান বান্ধবী। সে সুইডেনে গেস্ট-স্টুডেন্ট হয়ে লিনসোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে ১৯৮৫ সালে। আমরা একই ডরমিটরিতে থেকেছি দুই বছর। মাঝে মধ্যে বাংলা খাবার খেয়েছে আমার সঙ্গে।

রাতদুপুরে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের অদূরে, সান্তা মনিকা থেকে ফোন করেছে কীভাবে ডাল রান্না করবে তা জানতে। আমি চুপ করে রইলাম। ক্যাটরিন বললো, কাল ৭ মার্চ তাই মনে করেছি কিছু বন্ধুকে তোমার মতো করে ডাল-ভাত খাওয়াব। আমি শীতল গলায় বললাম, ঘটনা কী? বাংলাদেশি কারো প্রেমে পড়েছ নাকি? আরে না তুমি ৭ মার্চ পালন কর তাই।

সর্বনাশ, এতক্ষণে আমার ঘুম ভাঙল। যাই হোক ক্যাটরিনকে সহজভাবে বলে দিলাম ডাল রান্নার পদ্ধতি। সে আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলল এবং এও বলল, রাতে টেলিফোন করবে খাবার শেষে। আমি টেলিফোন রেখে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করা বৃথা হবে।

এক কাপ কফি তৈরি করে তা নিয়ে বসে গেলাম সুইডিশ নিউজ পেপার পড়তে। কফি শেষ করে বড় ভাইকে ফোন করলাম। বড় ভাই মান্নান মৃধা তখন পিএইচডি স্টুডেন্ট।

আমাদের প্রথম থেকেই পরিকল্পনা রয়েছে এবার বাংলাদেশ ইভিনিং পার্টি হবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বললাম, প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে আপনার সঙ্গে আরেকবার বসা দরকার। কারণ এবার অনেক লোক হবে। তারপর স্টকহোম থেকে বাদ্যযন্ত্রসহ কিছু বাংলাদেশি, আমাদের রাষ্ট্রদূত এবং তার পরিবার অনুষ্ঠানে থাকবে। মান্নান ভাই বললেন, টেনশন করো না সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, এখনও তো দেরি আছে। আমি বললাম, দেরি আপনি কোথায় দেখলেন? কয়েক ঘণ্টা মাত্র বাকি। শালাদের একটা ভেলকি দেখিয়ে দেব না? বাংলাদেশ বললে চিনতে পারে না, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছা করে আমাদের দেশটাকে না চেনার ভান করে। এবার শালারা বুঝবে বাংলাদেশ কী জিনিস!

একই সঙ্গে পাকিস্তান এবং ভারতের শিক্ষার্থীদের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। যখন দেখবে বাংলাদেশের অনুষ্ঠান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। সবাই অবাক! স্টকহোম থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালিরা আসতে শুরু করেছে। চুপচাপ হয়ে সবাই বসে আছে, মাঝে মধ্যে আমি গম্ভীর গলায় মান্নান ভাইকে বলছি, শালারা ভাবছে এখন বাংলাদেশ কী জিনিস। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। আমি আরও কয়েকটি গান গেলাম, তবে সুন্দর গেয়েছিলাম জাতীয় সংগীতটি। মান্নান ভাই কবিতা আবৃত্তি করলেন। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের ওপর কিছু বললেন। বিদেশ-বিভুঁইয়ে গান শুনে দেশের জন্য অনেকেরই বুক হু-হু করতে লাগল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের চোখে জল এসে গেল। কেউ যেন তা দেখতে না পায় সে জন্য অনেকে মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হলো। সবাই বেশ মজা করেই খেল। শীতের সময় (নভেম্বর-এপ্রিল) এখানে প্রারই সূর্যের দেখা মেলে না, তবে মার্চ মাসের শীতের দিনগুলো বেশ বড় হতে শুরু করে। সূর্য সন্ধা ৬ টার আগে ডুবে না। চলছে চা-কফির আড্ডা।

সব শেষে বিদায়ের পালা। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলল, অনুষ্ঠানের পুরো খরচ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে। সবাই কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। মান্নান ভাই মনে হলো একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। পরে সুইডিশদের কাছ থেকে শুনেছি, আমাদের অনুষ্ঠানটি ওদের খুবই পছন্দ হয়েছিল। সেই থেকে লিনসোপিংয়ে অনেকের মুখে মুখে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ।

এ ঘটনার পরে আমাকে একবার এক পাকিস্তানি প্রস্তাব দিয়ে বলেছিল, আমরা যদি তাদের সঙ্গে একত্রে একটি অনুষ্ঠান করি তাহলে কেমন হয়? কেন যেন তখন বারবার মনে হয়েছিল না কখনো না, যারা আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠান?

যাই হোক পরদিন লিনসোপিংয়ের পত্রিকায় বাংলাদেশ ৭ মার্চ সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হয়। খবরের অংশবিশেষ এ রকম ছিল- একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে।

লেখক: সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

এবি//দৈনিক দেশতথ্য//মার্চ ০৭,২০২২//