ফাইজুস সালেহীন: সেদিন গফরগাঁও গিয়ে হঠাৎ মনে হলো আমাদের কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক আখতার স্যারকে সালাম দিয়ে যাই। সাথে যৌবনকালের বন্ধু লেখক ইমাম উদ্দিন। স্যার বয়সের ভারে ন্যুব্জ; শয্যাশায়ী। আখতার স্যার শাঁখচূড়া হাইস্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। তখনও অবশ্য আমার হাইস্কুলে পা রাখা হয়নি।
স্যারের পাশে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ তাঁর দুচোখের পানি আর বাঁধ মানেনি। আবেগের আবির ভেসে যাচ্ছিলো অরোধ্য অশ্রুবানে। স্যারের আবেগ পশ্চাতে ফেলে গফরগাঁও ইসলামিয়া হাইস্কুলের পেছনের রাস্তা দিয়ে ফিরছি। তখন চোখে পড়লো এই পরিত্যাক্ত জীর্ণ কাঠকেওয়ারি চৌচালা ঘরটি। পেছনের মরা গাছটিও বুঝি কিছু বলতে চেয়েছিল। তার সেই নির্বাক বলা কানে না পৌঁছাতে পারলেও স্মৃতিতে হয়ে উঠলো জাগররুক। শৈশবের স্মৃতিঘেরা এই চৌচালা। কোয়ার্টারের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় আরও একটি চৌচালা ছিলো। তার সামনের অর্ধেকটা বৈঠকখানা আর অর্ধেক অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রাচীরঘেরা এই বাসার পূবে ছিলো রান্নাঘর। সামনে গেটের পাশে ছিলো বড় একটা জামের গাছ। আম-কাঁঠালের গাছগাছালি ছিলো অনেক। এর মধ্যে জামগাছের স্মৃতি একটু বেশিই মনে আছে।
দাদা তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। ফলফলাদির ভরা মৌসুম। ডালেডালে টসটসে কালোজাম। দাদা জাম পাড়তে উঠে গেলেন গাছের মগডালে। ঝাঁকি দিয়ে গাছের ডালে তুললেন কালবৈশাখীর দোলন। সেই দোলনে শিলা ঝড়ের মতো পড়তে শুরু করলো জাম। মূহূর্তর মধ্যে ভরে গেল নিচে আমাদের হাতে ধরা চাদর। এরপর শব্দ করে ভেঙ্গে গেল গাছের ডাল। ডালটি পতনের ধরন ছিল হেলিকপ্টার ল্যান্ডিংয়ের মতো। আমরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এর ক্ষণকাল পরে চোখ খুলে দেখলাম ঘোড়ার পিঠে যেমন সহিস লাগাম ধরে বসে থাকে, তেমনই দাদা বসে আছেন ভগ্ন ডালের ওপর।
এটি ইসলামিয়া হাইস্কুলের হেডমাস্টারের কোয়ার্টার। আব্বা সাড়ে তিন বছর এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমরা ছিলাম এই কোয়ার্টারের বাসিন্দা। ছবির এই ঘরেই ছোট দুই ভাই ও বোন টিপু আর দীপুর জন্ম হয়েছে। আমাদের পারিবারিক ইতিহাসে খুবই লক্ষ্মীমন্ত এই চৌচালা ঘরটি। আরেকটি ঘরের কথা যে বলেছি, স্মৃতির ঝাঁপিতে সেও কম কিছু নয়। পিঠাপিঠি ভাই নান্টুদা আর আমার সুন্নত হয়েছিল ওই বাংলাঘরে। ঠাটাকান্দার গুনি (হাজাম) এসে কিছু বুঝে উঠার আগেই ছ্যাৎ করে কেটে দিলেন।
একটু ভয় পাওয়ার সময়ও দিলেন না। মা বারান্দায় বসে পানি ভরতি একটা মাটির হাড়িতে দু হাত মুঠো করে রেখেছিলেন। শুনেছি পরে। এটাই নাকি নিয়ম। পরে ঠাটাকান্দার এই গুনীকে এক মহা উস্তাদ বলে মনে হতো। ছোট খাটো মানুষটি রেলি সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন খান বাহাদুর ইসমাইল সড়ক দিয়ে আসা যাওয়া করতেন। আর সামনে এলে বিনয়ের সাথে সালাম দিতাম। মুচকি হেসে তিনি সালাম নিতেন। এটা যেন তাঁর পাওনা সালাম, তাই কোনো দিন সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করেননি, তুমি কে হে বাপু! পিতার নাম কি? কিন্তু জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন; যখন দফতরি বাবর ভাই পেছন থেকে চোখ ধরে রেখেছিলেন। আমাকে জলচৌকিতে বসিয়ে নতুন কড়কড়া তহবনের দরোজা খুলে হাজাম জানতে চাইলেন, তোমার নাম কী। কোন স্কুলে পড়ো, ডরাইছো, ডরায়ো না। কান্না জড়ানো গলায় ‘না’ শব্দটি করেছি কী করিনি, অমনি ঘ্যাচাং। এমনই আরও অনেক স্মৃতি এই কোয়ার্টার ঘিরে। সব কি বলা যায় একদিনে!
সেই কোয়ার্টার এখন নিশ্চিহ্নের পথে। এই ঘরটি আছে কালের সাক্ষী হয়ে। হয়তো আর বেশিদিন থাকবে না। তাই পেছন দিক থেকে হলেও একটা ছবি তুলে রাখলাম। সামান্য স্মৃতি আরকি!
দৈনিক দেশতথ্যের পাঠকদের জন্য লেখাটি পাঠিয়েছে প্রখ্যাত কলামিস্ট ও দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক এ্যাসিসট্যান্ট এডিটর ফাইজুস সালেহীন।
(এবি/দৈনিক দেশতথ্য/০৬ অক্টোবর/২০২১)
বি:দ্র: দৈনিক দেশতথ্য এমন স্মৃতিকে খুবই গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে। আপনিও পাঠাতে পারেন সেই সব স্মৃতি যা এখনো আপনাকে আবেগাপ্লুত করে।