রফিকুল্লাহ্ কালবী, কুষ্টিয়া :
ডেডলাইন- ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, মধ্যরাত। লোকালিটি- ‘কোহিনুর ভিলা’, রজব আলি সড়ক, রাজারহাট, কুষ্টিয়া। ইভেন্টস- নিকটবর্তী বিহারি পল্লী থেকে একদল যুবক হামলা করে কোহিনুর ভিলায়, শিশু ও গর্ভবতী নারীসহ বাড়িতে উপস্থিত ১৬ জনকে জবাই করে হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে সম্ভবত এরচেয়ে বড় ট্রাজেডি দ্বিতীয়টি ঘটেনি।
বিস্তারিত- কোহিনুর ভিলার মালিক ছিলেন তিন ভাই রবিউল হক, রেজাউল হক ও আরশেদ আলি। এই বাড়িতে ছিলো একটি সুপ্রসিদ্ধ বিস্কুট ফ্যাক্টরি। নাম ছিলো- ‘কোহিনুর ব্রেড এ্যান্ড বেকারি’। যুদ্ধের সময় এখান থেকে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের শুকনো খাবার সর্বরাহ করা হতো। বিষয়টি একসময় গোপন থাকে না। নিকটবর্তী বিহারি পল্লীর লোকজন এই খবর জেনে যায়। খবর চলে যায় কুষ্টিয়ায় অবস্থিত পাক আর্মি ক্যাম্পে। তারপর ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে বিহারি ক্যাম্পের দুর্ধষ যুবকেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে একযোগে হামলা করে কোহিনুর ভিলায়। জানা যায়, হামলাকারীদের প্রত্যেকেই ছিলো মদ্যপ অবস্থায়। বাড়িতে প্রবেশ করেই তারা গ্রাম্যফোন রেকর্ডে বিকট জোরে গান বাজাতে থাকে, যাতে প্রতিবেশীরা মনে করে যে, কোহিনুর ভিলায় কোন অনুষ্ঠান চলছে। বিকট বাদ্যের তালে তালে সারারাত ধরে চলে নির্মম হত্যাকাণ্ড।
ছবিতে প্রদর্শিত কোহিনুর ভিলার বিভিন্ন কক্ষে চলে ছুরি চাকু দিয়ে বিভৎস রক্তের উল্লাস। একে একে প্রত্যেকে জবাই করে হত্যা করা হয় পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে। খুন করা হয় রবিউল হক ও তার দুই স্ত্রী, পুত্র আব্দুল মান্নান ও আব্দুল হান্নান, কন্যা রিজিয়া, বাতাসি ও জরিনা, ভাই রেজাউল হক ও আরশেদ আলি, বেগম আরশেদ আলি, ভাতিজা রাজু ও আশরাফ, ভাতিজি আনু ও আফরোজা এবং দোকানের কর্মচারি আসাদ। সকালে প্রতিবেশীরা এসে দেখেন বাড়ির সবখানে শুধু রক্ত আর লাশের স্তূপ। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য জীবনে তারা আর কখনোই দেখেননি। হত্যা করা হয়েছিলো ৩ বছরের শিশুকে এবং গর্ভবতী মহিলাও বাদ পড়েননি। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন জঘন্যতর নির্মমতা দ্বিতীয়টি ঘটেছে বলে জানা যায় না। কোহিনুর ভিলার পূর্বপাশের খালি জায়গায় মোট চারটি কবর খোঁড়া হয়। বড়দের তিনজন ও ছোটদের পাঁচজন করে প্রতিটি কবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। বিহারিরা সেদিন শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দানকারী একটি পরিবারকেই হত্যা করেনি তারা কোহিনুর ভিলায় নির্বিচার লুটতরাজ চালিয়েছিলো।
এই পরিবারটির আদি নিবাশ ছিলো পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। রবিউল হক দেশবিভাগের পর ১৯৫১ সালে তার পরিবার ও দুই ভাইকে নিয়ে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের কুষ্টিয়ায় এসে নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার অপর ভাইগণ থেকে যান পৈতৃক ভিটা হুগলিতে। যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রবিউল হকের বড় ভাই ইসমাইল মল্লিক সপরিবারে ভাই নিহত হবার খবর শুনে হুগলি থেকে কুষ্টিয়ায় কোহিনুর ভিলায় আসেন। তবে ইসমাইল মল্লিক যে নিহত পরিবারের বড় ভাই- এটা প্রমাণ করতে তাকে কয়েক বছর ধরে কোর্টকাচারি করতে হয়। অবশেষে ১৯৭৮ সালে তিনি নিজের দাবির পক্ষে রায় পান। পরে ইসমাইল মল্লিক কোহিনুর ভিলাতেই বসবাস করতে থাকেন এবং এখানেই তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মৃত ইসমাইল মল্লিকের ছেলে হালিম মল্লিক বলেন, বহু বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছি কিন্তু এক রাতে একই পরিবারের ১৬ নিহত ব্যক্তিকে আজও পর্যন্ত শহীদের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড বিভিন্ন সময় নানান আশ্বাস দিলেও আদতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা আফতাব হোসেন ও মতিউর রহমান বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দানকারী কোহিনুর ভিলার যে পরিবারটি নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো তাদেরকে এখন পর্যন্ত শহীদের স্বীকৃতি না দেয়া খুবই দুঃখজনক। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু দাবি করেন, এই পরিবারকে অবশ্যই শহীদের স্বীকৃতি দিতে হবে, বাড়িটিকে কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর বানাতে হবে এবং গণকবরকে সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
হালিম মল্লিক বলেন, ৫৪ বছরের প্রচেষ্টা অদ্যাবধি আলোর মুখ না দেখায় এবং নানান অর্থ কষ্টের ফলে চার বছর আগে তারা বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছেন। ২০১০ সালে কোহিনুর ভিলার সামনে ১৬ নিহতের নাম ও বয়স সম্বলিত একটি নামফলক টাঙানো হয়। বাড়ির নতুন মালিক জুলাই বিপ্লবের পরে সেই নামফলকটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির পেছনের গণকবরে প্রবেশের কোন রাস্তা নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করলে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই ঐতিহাসিক বাড়ি ও গণকবর হয়তো অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, কোহিনুর ভিলার মালিক নিহত রবিউল হক শুধু একজন জনদরদী মানুষই ছিলেন না, তিনি একজন সমাজহিতৈষী শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিও ছিলেন। কোহিনুর ভিলার পাশে এখনকার ‘মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’র তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।