মো.আলাউদ্দীন, হাটহাজারীঃ দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে প্রায় তিনশত নৌকা নিয়ে ‘রেকর্ড পরিমাণ’ মা মাছের ডিম সংগ্রহ করেছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
রবিবার (১৮ জুন) মধ্যরাত থেকে সোমবার সকাল হালকা নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পর্যন্ত রুই, কাতল, মৃগেল ও কালাবাউশ মাছের ডিম সংগ্রহ করেন তারা। উৎসবমুখর পরিবেশে ব্যাপক ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে উপজেলা প্রশাসন কেউ যাতে হালদার রেনুর সাথে স্থানীয় হ্যাচারির রেনু মিশিয়ে ভেজাল সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন বলে জানা গেছে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.শাহিদুল আলম হালদা নদীতে পুরোদমে ডিম ছাড়ার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, হালদা নদীতে রবিবার দিবাগত রাতে পুরোদমে ডিম ছাড়ে মা মাছ। নদীতে মাছের ডিম ছাড়ার পাঁচটি জো/তিথি এর মধ্যে চলে গেছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশের জন্য ডিম আহরণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে ডিম সংগ্রহকারীরা নদী পাড়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় করছিলেন গত বেশ কয়েকদিন ধরে। অবশেষে ডিম ছাড়ায় সবাই উৎসবের আমেজে ডিম সংগ্রহ করেছে।
রোববার রাত ১২টার দিকে খবর পায় নাপিতের ঘোনা, আমতুয়ায় প্রচুর ডিম পাওয়া যাচ্ছে। সোমবার ভোর ৪টা পর্যন্ত হালদার বিভিন্ন পয়েন্ট হতে তিন শতাধিক নৌকায় ৭০০ ডিম সংগ্রহকারী পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম আহরণ করেন। ডিমগুলো থেকে রেনু তৈরির জন্য ৪টি সরকারি ১ টি বেসরকারি হ্যাচারী রয়েছে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, এরকম একটি দিনের অপেক্ষায় ছিলাম দীর্ঘ ২৩ বছর। আগে গল্পের মত শুনতাম নৌকাতে সংকুলন না হওয়ায় ডিম ছেড়ে দিয়ে আসতে। আজকে নিজের চোখে দেখলাম ডিম ছেড়ে দিয়ে আসতে। এ সফলতা হালদা নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকলের।
সংশ্লিষ্টরা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিট) মা মাছের ডিমের সঠিক পরিমাণ জানাতে পারেননি। তবে তারা অনুমান করছেন এবার গতবারের ৩ গুণ বেশি ডিম সংগ্রহ হবে।কেউ কেউ বলছেন বিগত ৭/৮ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এবারের ডিম সংগ্রহ। হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি এবং ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার থেকে অমাবস্যার শেষ জো শুরু হয়। শনিবার সকালের দিকে বজ্রসহ বৃষ্টির শুরু হলে ডিম সংগ্রহকারীরা আশান্বিত হন এবং তারা অনুমান করেছিলেন শনিবার দিবাগত রাতের যেকোনো সময় হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে। তবে তাদের সে ধারনা সঠিক হয়নি। পরে রবিবার দিবাগত রাতে মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়তে শুরু করে। তবে ইতোমধ্যে পরপর পাঁচটি জো (ডিম ছাড়ার সময়) শেষ হয়ে গেলেও মা মাছ পুরোদমে ডিম না ছাড়ায় অনেক ডিম সংগ্রহকারীরা ধারণা করেছিলেন এবার হালদা নদীতে হয়তো মা মাছ আর ডিম ছাড়বে না। তবে তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে অবশেষে শেষ জোতে মা মাছ রবিবার দিবাগত মধ্য রাত থেকে পুরোদমে ডিম ছাড়া শুরু করে।
হালদা গবেষক ড. শফিকুল ইসলাম জানান, হালদা নদী মিঠা পানির মেজরকার্প জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল, এবং কালিবাউশ) একটি অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং প্রজননের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটারসমূহ অনুকূলে না থাকায় এতোদিন পুরোদমে ডিম ছাড়েনি তবে রবিবার রাতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হওয়ার পুরোদমে ডিম ছাড়ে কার্পজাতীয় মা মাছ।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘রাতভর ডিম সংগ্রহ করে সকালে নিজস্ব হ্যাচারিতে নিয়ে যায় জেলেরা। সেখানে ১৮ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেনু হবে। তারা তিনদিন ধরে রেনুগুলোকে নার্সিং করবেন। এরপর পোনায় পরিণত হবে সেগুলো। অর্থাৎ সংগ্রহের ৯৬ ঘণ্টা পর মা মাছের ডিম বিক্রয়যোগ্য পোনায় পরিণত হবে।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো.শাহিদুল আলম জানান, হালদায় জেলেদের ডিম সংগ্রহে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। হালদার রেনুর সাথে স্থানীয় হ্যাচারির রেনু মিশিয়ে ভেজাল সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসন কাজ করছে।
দৈনিক দেশতথ্য// এইচ//