বাঙালীর গৌরব গাঁথা: বিশ্বযুদ্ধে বাঙালী রেজিমেন্ট
বীরের জাতি বাংগালি। যোদ্ধার জাতি বাংগালী। ১৯১৬ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটীশ সরকার বাঙালি রেজিমেন্ট পত্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। জার্মান অক্ষ শক্তির মোকাবিলায় ২৬ জুন, ১৯১৭ সালে বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গঠন করা বাঙালি রেজিমেন্ট। সৃষ্টিলগ্নে নামকরন করে “বেঙ্গলি ডাবল কোম্পানি”। শুরুতে প্রতি কোম্পানিতে সেনা সদস্য সংখ্যা ছিল ২২৮ জন। পরে নামকরন করা হয় ‘৪৯ নং বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’। এই রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন লেঃ এস জি টেলর। করাচীতে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের পাঠান হয় মধ্য প্রাচ্যের বাগদাদে। সেখানে এই রেজিমেন্ট মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধে অংশ নেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে এপ্রিল, ১৯১৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দিবিদ্রোহ দমনে ২৩৫ জন বাঙালি সেনাকে নিয়োগ করা হয়। অগাষ্ট, ১৯২০ সেনাদের কলকাতায় ফিরিয়ে এনে ৩০ অগাষ্ট, ১৯২০ বাঙালি পল্টন বিলুপ্ত করা হয়।
যদিও ইতিহাসের পাতায় অধিকাংশের বর্ণনায় এই রেজিমেন্টের ৪৯ জন সদস্য যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনের কথা উল্লেখ দেখা যায় কিন্তু কলকাতার কলেজ স্কয়ারে স্মৃতি রক্ষায় নির্মিত মনুমেন্টের তিন দিকে ৬৩ জন শহীদের রেজিষ্ট্রেশন নং, নাম, পদ, মৃত্যুর তারিখ, কোন জেলার অধিবাসী ইত্যাদি তথ্য খোদিত করে সংরক্ষণ করা রয়েছে। এ মর্মে যথারীতি গেজেটও প্রকাশিত হয়। মনুমেন্টের অন্য পাশে লিখা হয়েছে, “In Memory of Members of The 49th Bengalee Regiment Who Died in the Great War 1914-1919. To the Glory of God, King & Country”.
১৯১৯ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে মহাযুদ্ধের বিজয় উৎসব পালনে সারা বিশ্বের মিত্র বাহিনীর সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে উপমহাদেশ হতে একজন ব্রিটীশ, ৪৯ নং বাঙালি পল্টনের একজন ভারতীয় অফিসার, দুইজন সেনা সদস্য অংশ গ্রহন করেন।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, বেশিরভাগ নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সদস্য। যে সকল জেলা হতে সেনা সদস্য বাছাই করা হয় তন্মধ্যে ছিল পূর্ববঙ্গের যশোহর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল এবং পশ্চিমবঙ্গের ২৪-পরগনা, বর্ধমান, কলকাতা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মেদনীপুর, ত্রিপুরা জেলার বাসিন্দা। মেসোপটেমিয়া যুদ্ধে বিভিন্ন সাহসিকতা, গৌরব গাঁথার স্বীকৃতি স্বরূপ অনেক সদস্য পুরস্কার, সন্মাননা লাভ করেছিলেন যা গেজেটাকারে প্রকাশিত হয়েছে।
বাঙ্গালি পল্টনের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন খাঁজা হাবিবউল্লাহ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আর পি (রণদা প্রসাদ) সাহা, কথাসাহিত্যিক, সৈনিক, ইতিহাসবিদ চট্টগ্রামের মাহবুব-উল আলম।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধে তীব্র প্রতিবাদ, আন্দোলনে বাঙ্গালিরা ফেটে পড়ে, ঐতিহাসিকদের মতে যে জন্য কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয় এবং ব্রিটীশ শাসকদের মনে অজানিত বাঙালি ভীতি বাসা বেঁধে তাদের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরে এবং গভীর সন্দেহের বীজ রোপিত হয়।
যদিও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীতে সদস্য নিয়োগ করা হলেও বাঙ্গালিদের ভাগ্যে ছিকা ছেড়ে নি! এমন অবস্থার প্রেক্ষাপটে, দেশীয় রাজা-নবাব ও ঢনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ব্রিটিশ সরকারকে অর্থ এবং লোকবল দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। তাঁরা স্বদেশ রক্ষায় সেনা দলে বাঙ্গালি যুবকদের অন্তর্ভূক্তির জন্য সক্রিয় হন।
এই লক্ষ অর্জনে তাঁরা তৈরী করেন ‘বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটি’। কমিটির প্রধান ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মাহতাব। অন্যান্য সদস্য ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ঢাকার নবাব-বাহাদুর সৈয়দ নবাব আলি চৌধুরী, সরলা দেবী এবং শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক। তাঁরা তরুণদের সেনা বাহিনীতে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সেনাবাহিনীতে একটি বাঙালি ইউনিট/রেজিমেন্ট সৃষ্টির আবেদন জানান। তাঁদের প্রত্যক্ষ চেষ্টা ও যত্নে জন্ম নেয় ৪৯ নং বাঙ্গালি পল্টন। বাঙালি পল্টন হয়ে উঠেছিল বাঙ্গালির শৌর্য, বীর্য, সাহসিকতার প্রকাশ। মুক্তিসংগ্রাম-৭১ ঘটায় বাঙ্গালির শৌর্য, বীর্য, সাহসিকতার বিস্ফোরণ। এনে দেয় কবি নজরুলের ‘জয় বাংলার’ বিজয়, আরাধ্য স্বাধীনতা। ১ম মহাযুদ্ধে বাংগালিদের নিয়ে গঠিত হয় ৪৯ নং বাংগালি পল্টন। ’৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি জাতি পাকিস্তানকে দেখায় ‘জয় বাংলা’র ঐতিহাসিক বিজয়।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পর “পাকিরা” ‘আবিষ্কার করেছিল বাঙ্গালি জাতি যোদ্ধা না? বলতে গেলে এটা ছিল পাকিদের ‘কৌতুকপূর্ণ আন-ইসলামিক, বাঙালি বিদ্বেষী, অযাচিত আচরন’! এই আচরণের যথার্থ পরিণতি এবং নাকে ক্ষত দিয়ে শিক্ষা বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা পাকিদের দিয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ‘ক্যাঁচকা’ মাইর দিয়ে!
পাঠক আপনারা বিলক্ষন জানেন, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ দ্বিখন্ডিত হয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান ও ভারত। শুরুতে পাকিস্তানের হটকারী রাজনৈতিক নেতাদের অভিসন্ধির কবলে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। দেশরক্ষার সেনা বাহিনীতে বাঙ্গালির প্রবেশ নিয়ন্ত্রনে বলা হয় বাংগালি জাতি ‘যোদ্ধা নয় এবং যুদ্ধ মানসিকতা’ বিবর্জিত! অর্থাৎ ভীরু, কাপুরুষ। শৌর্য-বীর্যে পশ্চাতপদ!

আমরা কে না জানি, ১ম মহাযুদ্ধে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনের অবদান, বাঙালি সেনাদের বীরগাঁথার কথা? বাঙালি সেনাদের অমিত বিক্রমের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাণাক্ষরে লিখা রয়েছে। তাছাড়া নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদল ১ম মহাযুদ্ধে যে বীরত্ব প্রদর্শন করে তা এক অমর ইতিহাস।

Discussion about this post