Print Date & Time : 2 August 2025 Saturday 11:26 pm

৩১ জুয়াড়ির কাছে জিম্মি কর্ণফুলীর যুব সমাজ!

জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ৩১ জন মাস্টার জুয়াড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন অনলাইন জুয়ার অন্ধকার রাজ্য। এদের কাছে জিম্মি উঠতি তরুণ সমাজ। জুয়ার রাজ্যে তারাই শুধু রাজা। বাকি সদস্যরা সকলেই প্রজা। এসব অনলাইন জুয়াড়িরা শুধু কর্ণফুলীর শিকলবাহা, চরপাথরঘাটার ইছানগর, চরলক্ষ্যা ও জুলধা নয়। চট্টগ্রাম নগরীর অলিগলি ছাঁড়িয়ে তাদের নেটওয়ার্ক এখন মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও পৌঁছেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানায়।

অনুসন্ধানে মিলেছে, এসব যুবকদের দৃশ্যমান কোন ব্যবসা নেই। নেই চাকরি, নেই পূর্ব পুরুষদের স্বচ্ছতা। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিলো এই ৩১ জুয়াড়ির। কেউ কেউ করতেন গার্মেন্টস চাকরিও। কিন্তু এরাই এখন রাতারাতি লাখ ছাড়িয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক। একের পর এক শিকলবাহা, চরফরিদ, জুলধা ও ইছানগরে নির্মাণ করছেন আলিশান বাড়ি। কিনেছেন জমিজামা, গাড়ি ও ফ্ল্যাট।

গত তিন মাসের অনুসন্ধানে চার ইউনিয়নে অনলাইন জুয়ায় মাস্টার গডফাদার হিসেবে যে ৩১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা হলেন-মোহাম্মদ মুন্না, ম্যাক্স সাইমন, টিপু, খোকন, মীর আহমেদ, জিসান, সাজ্জাদ হোসেন, রনি, নজরুল ইসলাম, আজম, আশিক, রায়হান, মুরাদ, মোকতার,আরমান, আরবাব, আরিফ, নজরুল, ইরফান, শাহাজান, নুর মোহাম্মদ, দুলাল, আকরাম, টুটুল,জাবেদ, ফরিদ, ওসমান, সুমন, জাহেদ, আলমগীর ও হারুন। এরা সকলেই কর্ণফুলীর। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙানো সোর্স ক্যাশিয়ার সকলেই এদের চিনেন।

আরও তথ্য মিলে, এদের সকলেই অন্ধকার রাজ্যে এক পরিবার কিংবা এক সিণ্ডিকেট। সপ্তাহ মাস পেরোতেই দেশে বিদেশে তাদের গ্রুপ ট্যুর। মনরাঙাতে কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেট, রাঙামাটিতে তাদের মামুলি ভ্রমণ। দেশের গণ্ডি ফেরিয়ে থাইল্যাণ্ড, মালদ্বীপ, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ভারতের দার্জিলিং ও কাশ্মিরে চলে তাদের ট্যুরের আমোদফুর্তি। রয়েছে ওমরা পালনের নামে বিলাসি ভ্রমণও। 

জানা যায়, এসব পরিবারের ছেলেদের কয়েক বছর আগেও পোশাক আশাকে এত আভিজাত্য ছিল না। পরিবারকে সকালের খাবার যোগাতে বিকেল গড়িয়ে যেত। অথচ এখন এসব জুয়াড়িদের হাতে হাতে চোখ ধাঁধানো দামি আইফোন। চোখে গুচি, রেবন ব্রাণ্ডের চশমা। আর পায়ে নাইক, পুমা-এডিডাস। 

জানা যায়, সর্বৈব অনলাইন জুয়ার ফসল। এমনকি এই বিলাসি জীবনের আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের আরেক নাম বাজিধরা আর নেট ক্যাসিনো। যে জুয়ার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে কর্ণফুলীর সাধারণ উঠতি যুবক। নেশায় বুঁদ হয়ে অনেকেই বিপদে যাচ্ছে। কিন্তু গডফাদার আর এসব জুয়ার নিয়ন্ত্রণকারীরা নেট দুনিয়ায় রাজা হলেও পুলিশের হাতে এখনো অধরা।

একটি অসমর্থিত সূত্র জানায়, এসব জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়েছে কয়েকটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দুদক-এনবিআরের কাছে। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এদের উপর নজর রেখেছেন। 

অনুসন্ধানের তথ্য আরও বলছে, রাতে কিংবা দিনে অনলাইন অ্যাপসে রয়েছে তাদের তীর্যক চোখ। মিনিটে মিনিটে নিয়ন্ত্রণ। কারণ তাদের হাতেই রয়েছে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট একসেস ও পাসওয়ার্ড। ওরা যে কারো আইডিতে প্রবেশ করতে পারে। হ্যাক করতে পারেন ডলার-অর্থ। লোভনীয় অফারে যুবকদের জুয়ায় টানতে পারেন। এসব জুয়া খেলায় হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়া ৩১ জনের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে প্রতিবেদকের কাছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে। এতে রয়েছে সকল জুয়াড়ির আমলনামা।

জানা যায়, গত কয়েক মাসে এদের মধ্যে কয়েকজন আবার পেশা পাল্টিয়েছেন। গড়েছেন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বনেছেন মালিকও। যার সব কিছুর পেছনের শক্তি অনলাইন জুয়ার আয়। জুয়ার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলে রাতারাতি লাখপতি আর কোটিপতি তারা। বিলাসি জীবনযাপনে অভ্যস্ত এখন। বলতে গেলে অনলাইন জুয়ায় তাদের জীবনের চাকা খুলে যায়। হয়ে উঠেন নয়া কোটিপতি। নামে বেনামে গড়ে তুলেছেন সহায় সম্পদ।

অনুসন্ধানে তথ্য ওঠে আসে, কর্ণফুলীর ব্রিজঘাট এলাকার দুটি বিকাশ, নগদ, রকেট এজেন্ট, ইছানগরের একটি বিকাশ এজেন্ট, মইজ্জ্যারটেকের দুটি বিকাশ এজেন্ট, কলেজ বাজারের দুটি বিকাশ এজেন্ট ও শিকলবাহার চারটি বিকাশ এজেন্টে জুয়াড়িদের অস্বাভাবিক লেনদেন হয়। টাকার পরিমাণ বেড়ে গেলে ওরা কৌশলে শহরের বড় কোন এজেন্ট বা ব্যাংক বুথে নগদ ক্যাশ করেন। নাহয় নানা ব্যাংকিং কার্ড ব্যবহার করেন। ফান্ড পাল্টাতে এরা হঠাৎ ব্যাংকিং অ্যাপসও ব্যবহার করেন।

তাদের রয়েছে নামে বেনামে একাধিক পারসোনাল বিকাশ-নগদ-রকেট সিম। কারো রয়েছে এজেন্ট সিম। মাসে লেনদেন হয় লাখ লাখ টাকা। ৬ মাস ঘুরতেই কোটি কোটি টাকার লেনদেন। কর্ণফুলীর কয়েকজন এজেন্ট দোকান মালিকের কাছে প্রশ্ন ছুড়লেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। মুখে তালা লেগে যায়। নিয়মমতে লেনদেনের হিসাব নোট রাখার কথা থাকলেও এসব বিকাশ দোকানদারদের নেই দৈনিক লেনদেন খাতা। কারণ তলের বিড়াল বেরিয়ে যেতে পারে এ শঙ্কায় তারাও ভীত।

জানা যায়, অনলাইন জুয়ায় মূলত কমিশনে শূন্য থেকে লাখপতি-কোটিপতি হওয়ার গল্প তাদের। এসব অনলাইন জুয়াড়িদের রয়েছে একাধিক চক্র। অ্যাপের নিয়ম অনুযায়ী খেলার চিপস কিনতে প্রয়োজন পড়ে নগদ অর্থ, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড। ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছে অনলাইন জুয়ার দিকে। 

কখনো নিজের, কখনো তারা অন্যের সিম ধার করে চালান অনলাইন জুয়ার আসর। শিকলবাহা, ইছানগর, জুলধার জামতলায় বসে আসর। এদের  নামে-বেনামে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট সিমও রয়েছে বলে অনেকের দাবি।

এতে ‘ওয়ানএক্সব্যাট, মিলব্যাট, মোস্টব্যাট, বাবুএইটিএইট, ক্রিকেক্স, ক্যাসিনো জ্যাকপট সিটি, পারি, এমসিলাক, টুওয়াও, ভেগেস,পুলসজেড, মার্চ,কুইক উইন,স্পিন ক্যাসিনো, ব্যাটওয়ে, উইল্ড ফরচুন, ম্যাজিক রেড, রুবি ফরচুনসহ দেশী বিদেশী অনেক অ্যাপস ও সাইটেই তাদের বিচরণ। 

এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়। পরিচালনা বাহিরের দেশে হলেও বাংলাদেশে এগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি রয়েছে। যাদের হাজারে ৪০ টাকা কমিশন। 

স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, সন্দেহজনক অনলাইন জুয়াড়িদের তাৎক্ষণিক আটক করে। মোবাইল ফোন জব্দ করে। মোবাইলের অ্যাপস চেক করলে ধরা পড়বে নানান জুয়ার অ্যাপস। আর বিকাশ-নগদ অ্যাপসের এস্টেটমেন্ট দেখলেও সত্যতা মিলবে। অনেকের জিমেইল হিস্ট্রি আর গুগল ক্রোমের হিস্ট্রি চেক করলেও ডাটা পাওয়া যাবে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রাম মেট্টোর ইন্সপেক্টর সঞ্জয় গুহ বলেন, ‘সাইবার সিকিউরিটি আইনে এখন এটা অধর্তব্য অপরাধ! সত্যি কথা বলতে সামাজিক সচেতনতা এবং পারিবারিক কন্ট্রোল ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’

কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জহির হোসেন জানান, ‘অনলাইন জুয়ার ব্যাপারে তাঁরা শুনেছেন। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যা আমরা পুলিশের ওপেন হাউজ ডে অনুষ্ঠানেও বলেছি। মাদক, জুয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ সব সময় জিরো টলারেন্সে রয়েছে।’

সিএমপি বন্দর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘কেউ অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফরম তৈরি করলে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।’

এবি//দৈনিক দেশতথ্য//মার্চ ১১,২০২৪//