শেখ সুদীপ্ত শাহীন, লালমনিরহাট: ৪ এপ্রিল লালমনিরহাটে ইতিহাসের বর্রব পৈশাচিস জঘন্যতম গণহত্যার দিন। যারা মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা এসে দেখে যান। নিষ্ঠুর নির্মমতা মতটা বীভৎস ছিল যুদ্ধের ৯ মাসে। দিনটি সেই দিনও রমজান মাস ছিল। পবিত্র মাস। মুসলিম বিশ্ব বছরের এই একটি মাস হাজার মাসের সমান তাৎপর্যপূর্ণ । মুসলিমরা ধর্ম – কর্ম, নামাজ – রোজা, কোরান তেলোয়াত এবাদত বন্দিগী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল পবিত্র রমজান মাসে দিনে দুপুরে প্রকাশ্য ইসলাম ধর্মের ও মুসলমান রক্ষার দোহাই দিয়ে বাঙ্গালি মুসলিম নিধনে নেমে পড়েছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও অবাঙ্গালি বেহারি গণ।
৭১’র ৪ এপ্রিল সকাল ১০ টায় লালমনিরহাট রেলওয়ে ষ্টেশনের পশ্চিম পার্শ্বে রিক্সা ষ্ট্যান্ডে ইতিহাসের নির্মম গণহতা চালায় পাকিস্তানী সেনা বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলসামস্ ও অবাঙ্গালী বিহারীরা। নরপশু ঘাতকরা বিভাগীয় রেলওয়ে দপ্তরের (ডিআরএম) অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী, ট্রেনযাত্রী, ষ্টেশন কেন্দ্রীক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, ষ্টেশনে অপেক্ষমান যাত্রী ও ভাসমান হকারদের ধরে নিয়ে আসে। সকলকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাখির মত গুলি করে হত্যা করে। সেখানে প্রায় ৫ শতাধিক নিরীহ নারী, পুরুষ, ট্রেন যাত্রী মূহুর্তে হত্যাকান্ডের শিকার হয়। মৃত্যুমুখে নিরীহ মানুষ গুলো পানি পানি বাঁচাও বাঁচাও চিৎকওে করলে পানির বদলে মুখে প্র¯্রাব করে দেয়। বাতানে কানপাতলে ইতিসাহের সেই নিষ্ঠুর হত্যা কান্ডের করুণ কথা এখনো ভেসে আসে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও শহরের আনাছে কানাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই দিনের সেই নির্মমতার স্মৃতিচিহ্ন।
সেই দিনের এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর মেজর সামুচদ্দার হক। সাথে ছিল অবাঙ্গালী রহমান কসাই, রাজাকার মহির, সুটকা রাজাকার, আলবদ, আলসামস্ মুসলীমলীগের তথাকথিত নেতা। ইতিহাসের এই জঘন্যতম গণহত্যাটি সংগঠিত পর লাশ গুলোকে টেনে হিঁচড়ে মাটিচাপা দিয়ে ঠিকাদারী কাজটি করেছিল জিএম কাদের এমপির ভগ্নিপতি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের তৎকালীণ প্রধান শিক্ষক জহুরুল হক। জহুরুল হক পাকিস্তানী সেনাদের যুদ্ধকালীণ রসদ সাপ্লাই দিয়ে ছিল। সেই সময় লালমনিরহাট শহরের হাঁড়িভাঙ্গা বিমান ঘাঁটি, রেলওয়ে ট্রেনিং স্কুল মাঠ ও শহরের প্রাণ কেন্দ্র রেলওয়ে অফিসার ক্লাব (সেই সময়ে নাচ ঘর নামে পরিচিত ছিল) এই তিনটি যায়গায় মুক্তিযুদ্ধকালী পাকিস্তানী সেনারা সেনা ছাউনি পেতে ছিল। এই তিনটি স্থানের অদুরে প্রতি রাতে শতশত নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে জবাই করে ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এমনও ঘটেছে জীবন্ত একই পরিবারের ৭ জন সহ ১১ জনকে মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়নের অপরাধে সাহেব পাড়ায় পিতা ও পুত্রকে জীবন্দত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেই চিহ্নি এখনো দগদগে ঘায়ের মত রয়ে গেছে। এই সব শহীদের কবর গুলো চিহ্নিত রয়েছে কিন্তু এখনো নর্দমায় অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা রেলওয়ে কতৃপক্ষ মর্যাদাপূর্ণ ভাবে সংরক্ষন করেনি। এখানে এমন ক্ষত চিহ্ন রয়েছে রেলওয়ে টিটিই এসএম আব্দুর রহমানকে কোয়াটারে হত্যা করে লাশ ঘরের উঠনে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিল। পাশের কোয়াটারে বসবাস করতেন ডিএমই অফিসের ক্লার্ক এমএ হাফিজ ও তার পুত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী (সরকারী মডেল স্কুলের শিক্ষার্থী) বেলাল সুজা। ১৮ এপ্রিল পিতা পুত্রকে রেলওয়ে কোয়াারের পিছনে নিয়ে গিয়ে জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে রাখে। তাদের অপরাধ ছিল ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীণ পাকিস্তানের জাতীয় দিবস ছিল। সেই দিন রেলওয়ে কোয়াটারের কর্মকর্তার স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী সন্তানরা রেলওয়ে এখন যেখানে রেলওয়ে দূর্গা মন্দির ( সেই সময় ছিল না।) স্থানটি ছিল ফাঁকা মাঠ। সেখানে পাকিস্তানের পকাতার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে শহীদ এমএ হাফিজ সন্তান জেলাল শফি। বিভাগীয় ম্যানেজারের কার্যালয় সংলগ্ন(ডিআরএম) অফিসের পাশে জলমগ্ন ডোবার জঙ্গলে লাশ গুলো মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। দেশ স্বাধীন হলে জায়গাটি হণকবর হিসাবে স্বীকৃত হয়।
বিভীষিকাময় এই ঘটনার কয়েকজন স্বাক্ষী এখনো বেঁচে আছে। তাঁদের একজন রেলওয়ে কর্মচারীর সন্তান (বর্তমানে রং মিস্ত্রির পেশায় নিয়োজিত) মোঃ আকতার হোসেন(৬৫) জানায়, অবাঙ্গালী কালুয়া গুন্ডা, রশিদ কসাই, কুখ্যাত রাজাকার মহির গং এই হত্যা কান্ডের নেতৃত্ব দিয়ে ছিল। পাকিস্তানী এক মেজর সামুদ্দর হক দাঁড়িয়ে থেকে নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের মিশন শেষ করে। সেদিনের সেই নির্মম ঘটনার কথা স্বরণ হলে এখনো ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের বিচার হয়নি। তাঁদের অনেকেই এখনো বাংলার মাটিতে বেঁচে আছে। ভোল্টপাল্টিয়ে ক্ষমতাসিনদের সাথে আঁতাত করে আস্ফলং দেখাচ্ছে। তাদের মধ্যে স্বৈরশাসক হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের আতœীয় স্বজনরা রয়েছে। রয়েছে মোগলহাটের জাপা নেতা ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতার বাবা ও স্বজনরা। তারা এখন দেশের রাজনৈতিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
সেই সময়ের কিশোর অকতার হোসেন জানায়, তাঁকেও পাকসেনা ও তাঁদের দোষররা গুলি করে ছিল। গুলি এসে পায়ে লাগে। মৃত্যু যন্ত্রণায় পানি পানি কওে ছটফট করলে মুখে প্রসাব করে দেয়। এক পর্যায়ে জ্ঞানহারিয়ে ফেলে সে। তাঁকে মৃতভেবে মাঠি চাপা দিতে খালে শতশত মৃত্যুদেহের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। মাটি চাপা দিতে আসা এক হরিজন ( সুইপার) সে বেঁছে আছে। তাঁকে সে বাঁচিয়ে রাখে। সেই দিনের বেঁচে যাওয়া আহত কয়েক জন রেলওয়ে কর্মীকে রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি করা হয়। সেই অপরাধে পাকিস্তানী বর্বর সেনা ও অবাঙ্গালি রাজাকার গণ রেলওয়ে হাসপাতালে হামলা করে হাসপাতালে চিকিৎস আব্দুর রহমান কর্মচারী ও রোগীতের গুলি কওে হত্যা করা হয়।
বীরমুক্তিযোদ্ধা অবসর প্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মী আব্দুস ছালাম (৮০) জানায়, ৪ এপ্রিল গণহত্যায় শহীদদের পুর্নাঙ্গ নামের তালিকা স্বাধীনতার ৪৪ বছওে তৈরী করা হয়নি। রেলওয়ের ৮৩ জন শহীদের নামের তালিকা রেলওয়ে শহীদ মিনার ( মুক্তমঞ্চে) রয়েছে। দীর্ঘ সংস্কারের অভাবে যাহা মুছে যেতে বসেছে। রেলওয়ে মুুক্তিযোদ্ধাদের পৃথক অলিখিত ইউনিট ছিল। তারা সব সময় পাকিস্তানী সেনাদের রেলওয়ে যোগাযোগের খবরা খবর মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন। এছাড়াও রেলওয়ের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা কে গোপনে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করেছে। তাই তো দেখা যায় যুদ্ধকালীণ সময়ে বীরমুক্তিযোদ্ধারা এ্যম্বুশ করে পাকিস্তানী রেলওয়ে ট্রেনের অনভয়ে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে ছিল। এমন অপারেশন লালমনিরতাট রেলওয়ে বিভাগের অধীনে জয়মনি, আদিতমারী, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, গাইবান্ধা, বালাসীঘাট, কুড়িগ্রামের রৌমারীতে হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বররে রেলওয়ে তিস্তা সেতুর পাড়ে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর এজাজ মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে গুলি বিদ্ধ হয়ে মারঅ যায়। সেই দিন বীরমুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধীর মুক্তি এক মেজর সহ অর্ধশতাধিক পাকিস্তানী সেনা মারা যায়।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post