আজ ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট মুক্ত দিবস।এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে সকাল হতে গ্রামে- গঞ্জে প্রবেশ করে। চারিদিকে বিজয়ের উল্লাস ও মুক্তির উদ্দীপনায় সাধারণ মানুষ উল্লসিত।
শহরে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা গণ সামরিক সরঞ্জাম, ট্রুপস নিয়ে প্রবেশ করেছে। কোথাও পাকিস্তানি হানাদারদ বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। একটু পরে ভারতীয় মিত্র বাহিনী ঢুকে পরবে।
এ খবরে ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায়ত্ব দেখা দেয় পাকিস্তানি হানাদারদ বাহিনী ও অবাঙালি বিহারিদের মধ্যে। তারা লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় দপ্তর হতে একটি বিশেষ ট্রেন নেয়। সেই ট্রেনটি মূলত ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধকালীন বিশেষ ট্রেন। সেই ট্রেনে বিহারি ও অবাঙ্গালিরাও গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শহরের চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধারা এ্যাম্বুশ করে রাখে। সন্ধ্যা পর অন্ধকার হলেই পাকিস্তানী বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়বে। বিষয়টি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনা কর্মকর্তা গণ গোয়েন্দাদের মাধ্যমে আর্চ করতে পারে। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী ঢুকে পরবে এই ধুঁয়া তুলে বাঙ্গালি রাজাকারদের সুসংগঠিত করে প্রতিরোধে নামে শহরের কয়েকটি জায়গায় পাহারায় বসায়। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা গণ গিয়ে উঠে সামরিক রিলিফ ট্রেনে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তারা রিলিফ ট্রেনে চড়ে পালিয়ে যায়।
রেলওয়ে অবসর প্রাপ্ত কর্মী বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছালাম জানান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ লালমনিরহাটের জন্য। পাকিস্তানি আর্মির রিলিফ ট্রেনটি নিয়ে তিস্তা রেলওয়ে সেতুর দক্ষিণ পাশে এসে পৌঁছালে আমরা কয়েক জন মুক্তিযুদ্ধা আক্রমণ করে বসি। আমাদের আক্রমণে তারা বেসামাল হয়ে যায়। পাকিস্তানি আর্মির রিলিফ ট্রেনে কমান্ডার মেজর এজাজ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনা স্থলে নিহত হয়। রেলওয়ে সেতুর উত্তরপাশে ট্রেনটি পৌঁছাতে পাকিস্তানি আর্মিরা গ্রেনেড মেরে তিস্তা সেতুর একটি স্পেন উড়িয়ে দেয়। যার কারণে তাৎক্ষণিক সেতু পাড় হতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধা গণ। রিলিফ ট্রেনটি নিয়ে আর্মিরা রংপুরের অভিমুখে পালিয়ে যায়। এভাবেই স্বাধীনতার স্বাদ পায় লালমনিরহাটের মানুষ। শত্রু মুক্তাঞ্চল ঘোষনা হয়ে যায় লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম। কারণ কুড়িগ্রাম জেলা সদরের প্রবেশপথ বা প্রবেশদ্বার ছিল এই তিস্তা রেল সেতু। গভীর রাতে পুনরায় তিস্তা পাড়ের দখল নিতে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল চেষ্টা চালায়। সেই দলটি এসে তিস্তা রেলওয়ে সেতুর নতুন নাম দেয় পাকিস্তানি নিহত আর্মির মেজরের নামে “মেজর এজাজ রেলওয়ে সেতু” মুক্তিযুদ্ধারা আবারও প্রতিরোধ গড়ে তুলে সেই সেতুর নাম ফলক টি গুড়িয়ে দেয়।
” ভুটান ও ভারতের স্বীকৃতি “
৬ ডিসেম্বর এদিন প্রথম দেশ হিসেবে ভুটান বাংলাদেশ কে প্রথম স্বাধীন রাস্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একই দিনে ভুটানের পর পরেই ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। লোকসভার অধিবেশনে এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা করেন। এসময় লোকসভার সদস্যরা দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণাকে স্বাগত জানান। একইসঙ্গে লোকসভার অধিবেশনে হর্ষধ্বনির সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হয়। এদিন ইন্দিরা গান্ধী অধিবেশনে তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি স্বৈরতান্ত্রিক ও গণহত্যা নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে ফেলেছে। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশে বাংলাদেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভারতের সিদ্ধান্ত তৎকালীণ সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানানো হয়। বর্তমান রাশিয়া
ভারতে ভুটান ও ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ভীত আগের দিন ৫ ডিসেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নিজেদের কর্মনীতি সম্পর্কে একটি বিবৃতি দেয় বিশ্ববাসীকে। সেই বিবৃতিতে ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যায়।
এদিনে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক তারবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার তারবার্তায় বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ও বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিবাদন জানাচ্ছে। তার এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত আমাদের বিজয়ের পথে অনেকখানি পথ ধাবিত করলো।’ ভারত সরকার বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন করায় ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বন্ধুত্ব শান্তি ও সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো।’
বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দানের কয়েক ঘণ্টা পরে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বলে জানা যায়।
” পাকিস্তানে এদিনে “
৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়ার ৫ ঘণ্টা পরে পাকিস্তান সরকার ভারতের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এক ঘোষণায় পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের স্বীকৃতির কারণে আমরা ভারতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করছি। ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের চরম বিদ্বেষ ও পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের সনদের নীতি বিরুদ্ধ। জাতিসংঘে শিগগির পাকিস্তান এই বিষয়টি উত্থাপন করবে।
“বিশ্ব মহলে এদিনে”
৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে ভুটান তারবার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের পর প্রথম কোন স্বাধীন রাস্ট্র বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেয়। এই দিনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ৮টি দেশের পক্ষে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়। এটি দ্বিতীয় বার উত্থাপিত প্রস্তাব। এতে ফের তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ( বর্তমান রাশিয়া) দ্বিতীয়বারের মত তাতে ভেটো প্রদান করে। প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেৎসেভের সঙ্গে বৈঠক করেন মস্কোতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ড. কে এস শেলভানকর। এসময় দুজনের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাপী বৈঠকে ভারতের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও পাক ভারত সমস্যায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের বিতর্ক নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়।
” দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ”
৬ ডিসেম্বর ভারত ও ভুটান স্বাধীন বাংলাদেশ কে স্বীকৃতির খবর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ সমরে এক মহা শক্তি হিসেবে রুপ লাভ করে। এই দিন শুধু লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম নয়, শত্রু মুক্ত হয় ফেনী, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও সুনামগঞ্জ।
” পাকিস্তানিদের ঢাকা মুক্ত রাখার ঘোষনা “
৬ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজি রাতে এক নির্দেশে ঝিনাইদহ অবস্থান থেকে সরে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ঢাকা রক্ষার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী তিনি ঢাকার পথে পেছনে এসে মেঘনার তীরে সৈন্য সমাবেশ করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা আর পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ ততক্ষণে ঢাকা-যশোর সড়ক মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পুরো মহাসড়ক মুক্তিযোদ্ধা গণ দখলে নিয়ে উল্লাস করতে থাকে। তাতে সাধারণ মানুষও যোগ দেয়।
৬ ডিসেম্বর হতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় হতে থাকে।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//