১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ে বাংলায় স্বাধীনতার সূর্য হয় অস্তমিত। সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে অনেক গ্রন্থ ও নাটক লেখা হয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভংগের প্রেক্ষাপটে বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২) রচনা করেন ঐতিহাসিক নাটক সিরাজদ্দৌলা।

তিনি সিরাজকে স্বদেশের তরে উৎসর্গীত বীর হিসেবে চিত্রিত করেন। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ কলকাতায় পেশাদার নাট্য কোম্পানি ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ তাঁর হাত ধরে প্রবর্তিত। জীবনের শেষ ভাগে হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শিষ্য। ১৯৫৬ সালে গিরিশচন্দ্রের জীবন অবলম্বনে নির্মিত ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ ছায়াচিত্র মুক্তি পায়।

অন্যদিকে ১৯৩৮ সালে বিখ্যাত নাটকার সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচনা করেন সিরাজদ্দৌলা নামে আরো একটি নাটক। এই নাটকে তিনি জাতীয় জীবনের অনৈক্য, বিভেদ, ব্যর্থতা্র চিত্র তুলে ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপন করেন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এই নাটকে সিরাজ হয়ে উঠেছেন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐক্যশক্তির প্রতীক, নায়ক। দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে তোলা ছিল তাঁর নাটকের উপজীব্য। বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী ছিলেন তাঁর সহপাঠী। তিনি অনুশীলন দলেও যোগ দিয়েছিলেন। নাটকার সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে ১৮৯২ সালে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৬১ সালে দেহত্যাগ করেন।
সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সিরাজদ্দৌলা নাটকটি ‘নাট্যনিকেতন মঞ্চে’ ২৮ জুন, ১৯৩৮ প্রথম মঞ্চস্থ হয়। সিরাজের চরিত্রে নির্মলেন্দু লাহিড়ী, লুৎফা চরিত্রে সরযুবালা, গোলাম হোসে্নের ভূমিকায় রবি রায় এবং আলেয়া চরিত্রে নীহারবালা অভিনয় করেন। এই নাটকের গানগুলির রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম।
সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সিরাজদ্দৌলা নাটকের কয়েকটি মর্মস্পর্শী, হদয়গ্রাহী সংলাপ পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।
নাটকটির সূচনা কথনঃ
সিরাজ:-‘…তোমার অন্তিম সময়ে তোমার সিংহাসন স্পর্শ করে যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম, আমরণ আমি তা পালন করব’।
মোহনলাল: গুপ্তচর ও নয় জাঁহাপনা। প্রাসাদের বাইরে নবাবের হিতৈষী যে সামান্য ক’টি নরনারী আছে, ও (আলেয়া) তাদেরই একজন। শত্রুপক্ষের সংবাদ সংগ্রহ করে ও আমাদের জানায়। ওর সব গেছে জাঁহাপনা, কিন্তু দেশপ্রেম যায়নি”।
গোলাম হোসেন: ‘দেখলাম বড় বড় সেনাপতি, রাজা, উজির সবাই স্বার্থের সন্মানে উন্মাদ। শুধু একটি লোক স্বার্থের খাতিরে, বাংলার স্বাধীনতা বাংলার মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করছে। সে হচ্ছে বাংলার হতভাগ্য নবাব। বাংলার জন্যেই বাংলার নবাবের প্রেমে পড়লাম, ব্যক্তির জন্য নয়।”
নাট্যকারের অসামান্য সৃষ্টি গোলাম হোসেনের চরিত্র। তার হেয়ালি কথা, বেশ ভূষার সাথে বাঙালির অবক্ষয় চরিত্র বাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে। আসল নাম পুরন্দর। সে ভাড় নয়। মূলতঃ ছদ্মবেশী দেশপ্রেমী সংবাদদাতা। সিরাজ: “ওয়াটস কোম্পানীর কথা থাক, ইংরেজ, ফরাসী-পর্তুগীজ প্রসংগ পরিহার করুন। নিজেদের কথা বলুন রাজা, নিজেদের কথা ভাবুন।”
জগৎশেঠ: “ভাবা যখন উচিত ছিল, তখন যে কিছুই ভাবেন নি জাহাপনা।” সিরাজ: “সে অপরাধ কি বার বার আমি স্বীকার করি নি। আপনাদের সকল অভিযোগ অবনত মস্তকে গ্রহন করিচি। কখনো কোনো কটুক্তির প্রতিবাদ করিনি। আপনাদের স্পর্ধা নিয়ে কখনও প্রশ্নও তুলিনি। আপনারা সারা দেশে আমার দুর্নাম রটিয়েছেন, কর্মচারীদের মনে অশ্রদ্ধা এনে দিয়েছেন, আত্মীয় স্বজনের মন দিয়েছেন বিষিয়ে। আর কত হেয় আমাকে করতে চান আপনারা? জগৎশেঠ: আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করে আমাদের লাভ?
সিরাজ: স্বার্থসিদ্ধি।
গোলাম হোসেন: “এ পরাজয়ের প্রয়োজন আছে। জাঁহাপনা, দাঁত থাকতে নির্বোধেরা দাঁতের মর্ম বোঝে না, দেশের স্বাধীনতা থাকতে অপদার্থরা স্বাধীনতার মর্ম বোঝে না। দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করে যে স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ আপনি বাঙালিকে দিয়েছিলেন বাঙালি তার মর্ম বোঝে না। তা না বুঝে সিংহাসনের লোভে আত্মহারা হয়ে নিজেরাই দলাদলি মারামারি করেচে। একটা প্রচন্ড আঘাত তার প্রয়োজন ছিল। পলাশী সেই আঘাতই তাকে করেচে।”
সিরাজ: “বাংলার প্রজাকুল যাতে সর্বহারা না হয়, তোমাদের সুখের সংসার যাতে না ভাস্কর পন্ডিতের রোষানলে ভস্মীভূত হয়, তোমাদের সন্তান-সন্ততিরা যাতে না পতঙ্গের মতো প্রাণ বলি দিতে বাধ্য হয়, তারই জন্যে, বিশ্বাস কর ভাই সব, শুধু তারই জন্যে যবনের দুর্নিবার আকর্ষণ উপেক্ষা করে বাংলা, বিহার , উড়িষ্যার পথেপ্রান্তরে সংগ্রামস্থলে উল্কার মতো আমি ছুটে বেড়িয়েচি। তারই পুরস্কার কি ওই কন্টক আসন? তারই পুরস্কার কি ওই ছিন্ন-পাদুকা? তারই পুরস্কার কি এই তস্করলভ্য লাঞ্ছনা?”
সিরাজদ্দৌলা নাটকের সংলাপ রচনায় শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত পারদর্শিতা প্রদর্শন করে সকল উল্লেখযোগ্য চরিত্রকে শুধু ঐতিহাসিক করে তোলেন নি, তিনি নাটকটিকে প্রভূতভাবে জনপ্রিয় করে দেশাত্ববোধ জাগ্রত করেছেন। তিনি বাঙালি জাতি্কে ব্রিটীশ শাসন বিরোধী এবং পরাধীনতার গ্লানী মোচন করে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে নাটকটির গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রি তৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল।
শেষ হয়ে হইল না শেষ। লুৎফা চরিত্রাভিনেত্রী সরযুবালা দেবী তাঁর “পড়ন্ত আলোয় শচীন্দ্রস্মৃতি” নিবন্ধে লিখেছেন, “সিরাজদ্দৌলার অভিনয় হচ্ছে। হঠাৎ শুনলাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র, হেমেন্দ্রকুমার রায় এসেছেন নাটক দেখতে। আমি মঞ্চের উপর লুৎফা’র অভিনয় করছি। লুৎফার সংলাপে ছিল, ‘চলুন জাঁহাপনা! আপনার হাত ধরে এই আঁধার রাতে আমরা বেরিয়ে পড়ি। কেউ জানবে না, বাংলার নবাব তার বেগমের হাত ধরে চিরদিনের মতো বাংলা থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন।’ হঠাৎই সামনের সারিতে নজর পড়লো, সুভাষচন্দ্র রুমাল বার করে চোখ মুছলেন। অভিনয় শেষে তিনি ভিতরে এসে শচীনদাকে জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। নেতাজী আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। আমরা অভিভূত হয়ে দুই মানুষকে আলিঙ্গনবদ্ধ দেখলাম।”
সুরযুবালা দেবী (১৯১২—১৯৯৪)। সিরাজের চরিত্রাভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু বিয়েটা স্থায়ী হয় নি। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সরযূবালা সরণি।


Discussion about this post