কুষ্টিয়ায় একটি মামলার জামিন শুনানী চলাকালে প্রকাশ্যে এজলাসে দাঁড়িয়ে ম্যাজিষ্ট্রেট’র হাড় ভেঙ্গে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ও সাবেক পিপি এ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম দুলাল। বুধবার দুপুর একটার দিকে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ১ম আদালতে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনা নিয়ে আদালত পাড়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। আইনজীবী সমিতির সভাপতির এ হুমকি পেয়ে সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট এজলাস ত্যাগ করে খাস কামরায় চলে যান।
এ ঘটনার পর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট’র নেতৃত্বে আদালতের বিচারকগণ দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছেন।
ঘটনাটি বেশ স্পর্শকাতর মনে করে ভয়ে আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নব-নির্বাচিত সভাপতি নূরুল ইসলাম দুলাল, বাক-বিতন্ডার কথা স্বীকার করলেও বিচারককে হুমকী প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
জানা যায়, বদলী জনিত কারণে ম্যাজিষ্ট্রেট না থাকায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ম্যাজিষ্ট্রেট মো: মুস্তাফিজুর রহমান একই সাথে কুষ্টিয়া সদর এবং দৌলতপুর আমলী আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
কুষ্টিয়া দৌলতপুর কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ১ম আদালতের বেঞ্চ সহকারী সোহাগ মান্নান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, একই সাথে কুষ্টিয়া সদর এবং দৌলতপুর আমলী আদালতের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ম্যাজিষ্ট্রেট মো: মুস্তাফিজুর রহমান। কুষ্টিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ১ম আদালতে বসে তিনি একই সাথে দুই আদালতের (সদর এবং দৌলতপুর) দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বুধবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে ম্যাজিষ্ট্রেট মো: মুস্তাফিজুর রহমান প্রথমে সদরের মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এর পর শুরু হয় দৌলতপুর আমলী আদালতের মামলার কার্যক্রম। দুপুর একটার দিকে দৌলতপুর জিআর ৪০/২২ মামলার জামিন শুনানী শুরু হয়। প্রথমে জুনিয়ার একজন আইনজীবী মামলার শুনানী করছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ও সাবেক পিপি এ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম দুলাল। এক পর্যায়ে তিনিও জামিন শুনানীতে অংশ নিয়ে আদালতকে বলেন, যে মামলা এই মামলায় আসামিকে ৭ দিন পরই জামিন প্রদান করা যায়। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হচ্ছে আসামি জেল হাজতে রয়েছে। জামিন পাচ্ছে না। তখন ম্যাজিষ্ট্রেট বলেন, আমার কাছে এই মামলার প্রথম শুনানী হচ্ছে। শুনানী শেষে ম্যাজিষ্ট্রেট না মঞ্জুর করেন।
এ সময় জেলা আইনজীবী সমিতির সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ও সাবেক পিপি এ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম দুলাল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং ম্যাজিষ্ট্রেটকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাকে আমি ভালো মত চিনি। আপনার হাড় আমি ভেঙ্গে দেব।
প্রকাশ্যে এজলাসে দাঁড়িয়ে আইনজীবী সভাপতির এই হুমকী শুনে আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্টরা সবাই হতবিহবল হয়ে পড়েন। এ কথা শোনার সাথে সাথে ম্যাজিষ্ট্রেট মো: মুস্তাফিজুর রহমান সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি যেহেতু আমার হাড় ভেঙ্গে দিতে চেয়েছেন তাই এই অবস্থায় আমার আর এই আদালতে থাকা ঠিক হবে না। এ কথা বলেই তিনি এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে যান। ম্যাজিষ্ট্রেট খাস কামরায় চলে যাওয়ার পর সভাপতি নূরুল ইসলাম দুলালও এজলাস ত্যাগ করেন।
প্রায় এক ঘন্টা খাস কারায় অবস্থানের পর আবারও দুপুর দুইটার দিকে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট এজলাসে বসেন। তবে আর কোন শুনানী বা কার্যক্রম পরিচালনা না করেই এ দিনের সব মামলার পরবর্তী দিন বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ ) নির্ধারণ করে খাস কামরা ত্যাগ করেন।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া সদর ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টের জিআরও শাহিন এবং কোর্ট সিএস আই আব্দুল হাকিম সাংবাদিকদের কাছে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া চীফ জুডিশিয়াল আদালতের নাজির নূরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ঘটনার সময় আমি সংশ্লিষ্ট আদালতে ছিলাম না। তবে বিষয়টি আমি পরে জেনেছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে পারবো না। এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে এবং স্বশরীরে আদালতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট মো: মুস্তাফিজুর রহমানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও অপারগতা প্রকাশ করায় তা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে আদালতে গিয়ে কুষ্টিয়ার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ তারিক এজাজের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি তাঁর সহকারী দিয়ে বলেন, হাইকোর্টের অনুমতি ছাড়া সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা মানা। এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নব নির্বাচিত সভাপতি নুরুল ইসলাম দুলাল বলেন, আমার বিরুদ্ধে ম্যাজিষ্ট্রেটকে হুমকী প্রদানের যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে জানান, এজলাসে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অতি দুর্বল মামলায় আসামিদের জামিন না মঞ্জু অনুরোধ জানিয়ে কিছু পরামর্শ দিলে তিনি আমাদের ওপর প্রচন্ড রেগে যান এবং অশালীন কথাবার্তা বলেন। পরে এ নিয়ে আইনজীবীদের সাথে তার বাকবিতন্ডা হয়। বিষয়টি নিয়ে পরে জেলা জজের উপস্থিতিতে আইনজীবী ও বিচারকদের সাথে নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি মিমাংসা হয়ে গেছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ২০ জানুয়ারি ভেড়ামারা উপজেলার মধ্য সাতবাড়িয়া এলাকার মৃত খতিবুর রহমানের ছেলে ফার্নিচার ব্যবসায়ী মহাসিন রহমান উজ্জল রাত ১১ টার দিকে দৌলতপুর বাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মটর সাইকেল যোগে বাড়ি ফেরার পথে আল্লারদর্গা বাজার এলাকায় পৌছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ড্রাম ট্রাক যার রেজি নং যশোর ট-১১-৫৪৭৮ এর চালক আতিকুর রহমান পেরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মটর সাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই উজ্জল নিহত হয় এবং মটর সাইকেল আরোহী মেহেদী গুরুতর আহত হন। এ সময় স্থানীয় জনতা ড্রাম ট্রাকের চালক সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বজ্র পাটুলিয়া গ্রামের শেখ রবিউল ইসলামের ছেলে আতিকুর রহমানকে (২২) আটক করে ট্রাকসহ পুলিশে সোপর্দ করে। পরের দিন নিহতের বড় ভাই হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারায় দৌলতপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই দিনই আসামি আতিকুর রহমানকে আদালতে হাজির করা হলে বিজ্ঞ আদালত আসামিকে কারাগারে প্রেরণ করেন। সেই থেকে আসামি আতিকুর রহমান কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে রয়েছেন। প্রসঙ্গত, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির (২০২২-২৩) মেয়াদের কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ১ম বারের মত সভাপতি পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নির্বাচিত হন নুরুল ইসলাম দুলাল। আর দ্বিতীয় বারের মত সাধরণ সম্পাদক নির্বাচিত হন একই প্যানেলের দেওয়ান মাসুদ করিম মিঠু। নুরুল ইসলাম দুলাল এর আগে বিভিন্ন সময় ৬ দফা কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং একাধিকবার পিপি’র দায়িত্বও পালন করেন।

Discussion about this post