আব্দুল বারী: শব্দটি বাংলা হলেও অর্থর কারনে ‘ধর্ষণ’ নিকৃষ্টতম বাংলা শব্দ। এই শব্দ উচ্চারণ করাও অনুচিত। তবে শব্দটিতে একটি বড় অপরাধ বুঝানোর কারণে এর ব্যবহার বেড়েছে। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে এই অপরাধের খবর। আগে এর শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এখন মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেও এটা কমানো যাচ্ছেনা।
দার্শনিক তথ্য মতে, ধর্ষণের নেশার তাড়না ক্ষুধার চেয়েও অনেকগুণ বেশি। এটা জীবের সহজাত প্রবৃত্তি। এই অপরাধের হার বেড়ে যাওয়া নিয়ে রয়েছে নানাবিধ যুক্তি। কারো মতে এর জন্য দায়ী নারীরা। কেউ বলেন পুরুষ, আবার কারো কারো মতে দায়ি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
যে যাই বলুক না কেন, এর বিশ্লেষণে যা পেয়েছি তা হলো এই যে, প্রকৃতির বিশাল এই জীব জগতে অনেক প্রকারের জীব আছে। এর মধ্যে মানুষ ও পশুকুলই প্রধান। মানুষ বাস করে সভ্য সমাজে। পশুকুলের বাস অসভ্য সমাজে। সভ্য সমাজে অপরাধ করলে শাস্তি ভোগ করতে হয়। আর অসভ্য সমাজে জোর যার মুল্লুখ তার নীতিই একমাত্র নিয়ম।
সভ্য সমাজের মানুষের আকারে পশুত্ব না থাকলেও তার মনে এর প্রভাব বিদ্যমান। এই তথ্যটুকু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানুষের মনে আছে দু’টি প্রবৃত্তি। এর একটির হলো সুপ্রবৃত্তি অপরটি কুপ্রবৃত্তি। সু প্রবৃত্তিতে আছে মনুষত্ব। আর কুপ্রবৃত্তিতে আছে পশুত্ব। সুপ্রবৃত্তি সদা জাগ্রত। কুপ্রবৃত্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুপ্ত। সভ্য সমাজে রয়েছে আইন মানার বাধ্যবাধকতা। অসভ্য সমাজে জীবের বিবেকবোধ ব্যতিত অন্য কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
সভ্য সমাজে আইন মানুষের স্বভাব ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আইন থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকলে করে পশু প্রবৃত্তির চর্চা। এর পেছনে যে জোরটি কাজ করে তা হলো এই যে, ধরা পড়লে শাস্তি না পড়লে পার।
মানুষের মনে যখন পশু প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় তখন চেহারায় মানুষ থাকলেও মানুষ মন এবং পশু মনের মধ্যে পার্থক্য থাকেনা। অপরাধের পর যখন তার মধ্যে সুপ্রবৃত্তি ফিরে বিবেককে নাড়া দেয় তখন আইনের সাজা থেকে বাঁচতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এসময় অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠে।
এই বিষয়গুলো বাস্তবতার সাথে মেলালে দেখা যায় এই সূত্রের পুরাটাই সঠিক। যেমন, বাসের যাত্রী মেয়েটিকে একা পেয়ে বাস চালক ও তার সহযোগীদের মধ্যে পশু প্রবৃত্তি ভর করেছিল। এই অপরাধে তাদের শাস্তি হতে পারে একথা তারা জানতো। তারা ভেবেছিল চলমান বাসের মধ্যে এই অপরাধটি করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। পশু প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার পর রাস্তায় নামিয়ে দিলেই পার পাওয়া যাবে। এই ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আইনের কঠোরতা জানার পরও তারা ধর্ষণের মতো অপরাধ করেছে।
অপরদিকে গত ৩০ মে রাতে ঢাকা মিরপুরের মাজার রোডের একটি মহিলা তার স্বামীকে পশু প্রবৃত্তির প্রভাবে হত্যা করেছে। এই অপরাধ করার পর তার মানুষ মন যখন জাগ্রত হয়েছে। এসময় সে আইনের কঠোরতা থেকে বাঁচার জন্য অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে সে লাশটিকে ছয় টুকরো করে পৃথক পৃথক বস্তায় ভরে স্বামীর লাশটি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফেলে দিয়ে এসেছে।
অপর ঘটনায় গ্রীন লাইফ হাসপাতালের একজন মহিলা ডাক্তার খুন হয়েছিলেন। খুনী পশু প্রবৃত্তির ভরে ডাক্তারকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করেছে। ডাক্তার যখন তার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে তখন তাকে হত্যা করেছে। আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘরে আগুন লাগিয়ে হত্যার ঘটনা আড়াল করতে চেয়েছে।
এমনি ভাবে অনেক বিবেকবান মানুষ পশু প্রবৃত্তির তাড়নায় শিশু ধর্ষণের মতো অপরাধ করে বসে। যখন তার মানুষ প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় তখন আর কিছুই করার থাকেনা। যেহেতু অপরাধ করে ফেলেছে সেহেতু সেই অপরাধের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য খুন করে আরেকটি অপরাধ করে বসে।
মানুষের মনে পশু প্রবৃত্তির তাড়নায় প্রতি নিয়ত ঘটছে খুন ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। কাজেই মানুষের মনে যাতে পশু প্রবৃত্তির তাড়না তৈরী না হয় সেজন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার প্রথম সূতিকাগার হলো পরিবার, দ্বিতীয় বিদ্যাঙ্গন, তৃতীয় সমাজ। এর মধ্যে বেশিরভাগ পরিবারে এখনো নৈতিক শিক্ষার প্রচলন আছে। বিদ্যাঙ্গন গুলোতে নৈতিক শিক্ষার পরিবেশ আছে একথা বলার সুযোগ একেবারেই দূর্বল। সমাজে যা ছিল মিশ্র সংষ্কৃতির প্রভাবে উবে গেছে।
এক্ষেত্রে পরিবারই একমাত্র ভরসা। এর পাশাপাশি বিদ্যাঙ্গন গুলোকে এব্যাপারে কাজে লাগানো যায়। সে ক্ষেত্রে সবার আগে যা প্রয়োজন তা হলো নৈতিকতার কাছে দায়বদ্ধ শিক্ষক। আবার অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে অপসংষ্কৃতির লাগাম টেনে ধরাও জরুরী। ব্যাক্তির স্খলন ঘটতে পারে এমন আইটেম আইটি থেকে বাদ দিতে হবে। এর পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও নৈতিকতার নিরিখে কাজ করতে হবে। এসব করতে পারলেই রোধ করা যেতে পারে সব ধরণের জঘন্য অপরাধ।
কিন্তু এভাবে আর কত কাল চলবে। যখনই এমন ঘটনা ঘটে তখনই সবাই সোচ্চার হয়। এরপর যতকে ততের মতোই থেমে যায় সব কিছু। তা নিয়ে সমাজ ও অসভ্য সমাজের মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। সভ্য সমাজে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। আছে সামাজিক বিচার। আছে পারিবারিক শাসন। নৈতিক শিক্ষা লাভের জন্য নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্লাটফর্ম।
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post