বাবা দিবেস প্রসঙ্গে বাবাকে নিয়েই আলোচনা করার কথা। বিশ্বব্যাপি হচ্ছেও তাই। এমন একটি দিনে বাবার স্মরণে মায়ের কথাও হয়ে গেছে প্রাসঙ্গিক। বাবা মা তাদের শেষ জীবনের বেশির ভাগ সময় সুইডেনে আমাদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। মায়ের কবর সুইডেনের লিনসোপিংএ । বাবার কবর বাংলাদেশে। এই দুটি মানুষ ৬০ বছর একসাথে থেকেছে। তারা একে অপরের প্রতি ছিল খুবই সংবেদশীল।
শেষ বয়সে সুইডেনে তারা আমাদের নিয়ে ছিলেন বেশ ভালোই। সেই ভালোতে হঠাৎ করে একদিন ছেদ পড়লো। মা স্ট্রোক করার পর চলাফেরায় অচল হয়ে পড়লেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাকে রিলিজ করে দিল। এরপর বাসাতেই করা হলো তার সব রকম নার্সিংয়ের ব্যবস্থা।
বাবা মায়ের সঙ্গে ২৪ ঘন্টাই থেকেছেন। মায়ের যত্ন করা, বিভিন্ন বিষয় খেয়াল রাখা, মায়ের কোনো প্রয়োজন হলে সেই প্রয়োজন মিটানো বাবা এগুলোকেই তখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বানিয়ে নিয়েছিলেন।
সারাজীবন শুনেছি স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। স্বামীরও যে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য থাকতে পারে বা আছে সেটা দেখেছি আমার বাবাকে দেখে। আমার অনেক ভাই বোন, বাবা চাকরী করেছেন। মা মূলত আমাদের সংসারের হাল ধরেছেন জীবনের শুরুতেই। বাবা-মা সমন্বয়ে কাজ করেছেন, বিপদে আপদে পরস্পর পরস্পরের পাশে থেকে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেছেন।
তাদের জীবন নামক সফর দেখেছি, তারা ছিলেন একে ওপরের সফরসঙ্গী। শিখেছি অনেক সেই দৈনিক শিক্ষা থেকে। ২০০৬ সালে মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল এখন কী হবে এই চিন্তায়। কোথায়, কখন, কীভাবে মায়ের মাটি হবে? মাকে বাংলাদেশে মাটি দিতে হবে ইত্যাদি। পরিবারের মধ্যে দুটো গ্রুপ হলো একটি গ্রুপের আশা মাকে দেশে মাটি দিতে হবে। সেভাবে তারা বাবাকে টেলিফোন করে মানসিকভাবে ভেঙ্গে দিতে উঠেপড়ে লেগে গেল। পরিবারের কেউ কেউ বলেছে তখন, অর্থের কারণে আমরা মাকে দেশে পাঠাতে রাজি হচ্ছি না ইত্যাদি।
উস্কানি দেবার মত লোকের অভাব নেই। বিপদের সময়ে এটা নতুন কিছু নয়। যদিও পরিবারের সবারই কম-বেশি সামর্থ রয়েছে সত্ত্বেও দায়িত্ব নেবার মত লোকের অভাব সব সময়ই ছিল। যাইহোক, শেষে মাকে লিনসোপিংএ কবর দেওয়া হলো। মূলত, আমার ছোটভাই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে সেটা ছিল প্রধান কারণ। বাবা মার পুরো দাফন থেকে শুরু করে কবর দেওয়া, জানাজা পড়ানো সমস্ত কাজগুলো দেখে বাবা খুবই সন্তুষ্ট হলেন। মনে হলো স্বস্তি ফিরে পেলেন। আলহামদুলিল্লাহ!!! পরেরদিন বাবা আমাদের সঙ্গে স্টকহোমে রওনা দিলেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান করবেন দেশে গিয়ে।
লিনসোপিং ( সুইডেনের একটি শহর) থেকে বিদায় নেবার আগে মায়ের কবরে বাবাকে নিয়ে আবারও গেলাম। বাবা ধর্মীয়ভাবে মায়ের থেকে বিদায় নিলেন। কে জানতো সেদিন বাবা আর ফিরে আসবেন না! এ দেখাই যে শেষ দেখা এবং আর যে দেখা হবে না!
মারিয়া আমার স্ত্রী গাড়ি চালাচ্ছে, আমি বাবা এবং আমার ছেলে-মেয়ে গাড়িতে। মনটা খারাপ। সবাই বেশ চুপচাপ।
বাবা বেশ স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন তোমার মা চলে গেলেন।
আমরা একসাথে গত ৬০ বছর ধরে সংসার করছি। একটা ছোট সরকারী চাকরী দিয়ে আমি সংসার জীবন শুরু করেছিলাম। সারাজীবন চেষ্টা করেছি সৎ থাকার জন্য। আল্লাহর কসম খেয়ে বলতে পারি জীবনে কোনদিন এক টাকা অসৎভাবে আয় করিনি। গ্রামের বাড়িতে বাবা-মাকেও কিছু টাকা পাঠাতে হতো। কখনো কখনো মাস শেষ হওয়ার আগে আমার বেতনের টাকা ফুরিয়ে যেত। সৎ থাকার কারণে আয়ও ছিল খুব সামান্য।
আমাদের ৭ ছেলে এবং ৪ মেয়ে ছিল। তোমার একভাই এবং একবোন মারা যায়। আমার সহকর্মীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে গরীব ছিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের কারণে আমি এটা কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনি। উনি যে কিভাবে সবকিছু ম্যানেজ করতেন একমাত্র উনিই জানেন। আমার সাধ্যের বাইরে জীবনে কখনো কোনদিন উনি কিছু দাবি করেননি। জীবনে কখনো আমাকে এটা বলেন নি যে, তুমি আমাকে এটা দিলে না, ওটা দিলে না। কখনো আমাকে আমার সামর্থ্য নিয়ে কষ্ট দিয়ে উনি কোনো কথা বলেননি। আজীবন ওনাকে শুধু সন্তুষ্টই দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি আমি উনাকে তেমন কিছুই দিতে পারিনি। তারপরও উনি কোনোদিন আমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেননি। তোমার মা একজন নেককার মানুষ ছিলেন। উনি উত্তম আচরণের অধিকারী ছিলেন। আত্মীয়তার হক রক্ষা করেছেন। পরোপকারী ছিলেন, স্বামী-সন্তানদের হক আদায় করেছেন। উনাকে আমি কখনো কোন নামায কাযা করতে দেখিনি। আজীবন পর্দা রক্ষা করে চলেছেন।
উনি ধৈর্যশীল ছিলেন এবং অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেন। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে বাবা একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ৭১ এর যুদ্ধে তোমার মা যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা তোমার থেকে আর কেউ ভালো জানে বলে মনে হয়না।
একটা দেশ স্বাধীন করতে, গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদেরকে অনুপ্রেরণা দেওয়া, নিজের ছেলেদের এবং স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়ে তোমাদের নিয়ে নিজ দেশে পরাধীন এবং শরনার্থী হয়ে দীর্ঘ নয়টি মাস সংগ্রাম করেছেন। সোনার বাংলা দেখার স্বপ্ন দেখেছেন। তোমাদের সবাইকে সেই ভাবে গড়ে তুলেছেন।
আমি আসলে তোমার মায়ের হয়ে তোমাকে কিছু বলার জন্য কথা বলছি না। যে নারী ৬০ বছর ধরে তার স্বামী-সন্তান এবং আত্মীয়দের হক রক্ষা করে চলেছেন তিনি অন্য কারো হক নষ্ট করতে পারেন না।
একজন জান্নাতী নারীর মধ্যে যা যা বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তার সবই তোমার মায়ের মাঝে ছিল। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করবেন।
আমি নিজে জান্নাতে যেতে পারবো কিনা জানি না। তোমরা শুধু এই দোয়া করো আমি যেন তোমার মায়ের সাথে জান্নাতে একত্রিত হতে পারি। আর তুমি সাক্ষী থাকো আমি তোমার মায়ের উপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট। আল্লাহ যেন উনাকে মাফ করে দেন।
আমি বাবার কথাগুলো অনুবাদ করছি একই সাথে এসময় মারিয়া (আমার স্ত্রী) আমার সঙ্গে বলে উঠল আমিন, আমিন, আমিন। গাড়ি চলছে আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো একজন স্বামীর মুখে তার জান্নাতী নারীর কথা শুনছি।
হাদিসে এসেছে, একজন মুমিন-মুমিনার জীবনে তার রবের তরফ থেকে সর্বোত্তম রিযিক হচ্ছে একজন নেককার স্বামী এবং স্ত্রী। বাবার কথা থেকে যেন সরাসরি এই হাদীসের প্রমাণ পেলাম।
বাবাকে নিয়ে স্টকহোমে ফিরে এলাম একটা অপূর্ব ভালো লাগা নিয়ে। সুখী মানুষদের কথা শোনার মধ্যেও একটা সুখ আছে। বাবা আর মা অত্যন্ত সুখী মানুষ ছিলেন। এই সুখ স্রষ্টা সরাসরি তাদের অন্তরে ঢেলে দিয়েছিলেন। বাবা দেশে যাবার পর মারা জান, মা আমার এখানে আছেন। যখন মন চায় ছুটে যাই মায়ের কবরে। এসেছিলাম লিনসোরিংএ মার কাছে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট) ফাইজার, সুইডেন।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//জুন ১৯,২০২২//

Discussion about this post