সুদীপ্ত শাহীন,নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট:
কল্পনা রানী বর্মন (৪২) দেশে একমাত্র নারী প্রতিমা তৈরির শিল্পী। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছাড়াই স্বামীর হাত ধরে দেখে দেখে শিখে গেছে কাদামাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ। প্রায় ২০ বছর ধরে পরম মমতায় কাদামাটি হাতে ছেনে ছেনে শৈল্পিক মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করছে প্রতিমা। দেবী মা মর্ত্যে এসে সকলকে আর্শীবাদ করে। সকলের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায়। প্রতিমা শিল্পী কল্পনা রানী বর্মনের ভাগ্যেও পরিবর্তন হয় না। দেবী তারপ্রতি প্রসন্ন হয়না। ফলে দারিদ্রতার ঘোচেনা কল্পনা রানীর পরিবারের। দূর্গাপ্রতিমা তৈরি কাজ শেষে বসে বসে অলস জীবন কাটে। সেই সময় শোলা দিয়ে তৈরি করে বিয়ে, পুজার সামগ্রী। কখনো কখনো ঘট পুজার প্রতিমা কালী, লক্ষী, গণেশ, রাধা কৃষ্ণর প্রতিমাও তৈরি করে। প্রতিমা তৈরি কে পেশা হিসেবে নিয়েছে। এই পেশায় আয় রোজগার অতিসামান্য। একটি প্রতিমা বানাতে প্রায় ২২/২৩ দিন লেগে যায়। আয় রোজগার নেই। প্রতিমা তৈরি মাটিসহ সকল সামগ্রী চড়াদামে কিনতে গিয়ে অবশিষ্ট খরচ থাকে না।
শিল্পী প্রতিমা রানী বর্মন জানান, এটা শুধু তার কাজ নয়, এটা তার কাছে ধর্ম। স্বর্গেও দেব-দেবী তার হাতের ছোঁয়ায় মর্ত্যে দেব, দেবী ও দেবতা রূপে আবির্ভাব ঘটে। তার ভক্তকুলকে মা আর্শীবাদ দিয়ে আবার মর্ত্যে হতে স্বর্গে ফিরে যায়। প্রতিমা তৈরির কাজে তার মনে শান্তি আসে। যখন দেখেন, বিগ্রহ প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার মানবসন্তানেরা প্রাণ ভরে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। তখন তার মনে যেন, প্রশান্তির ছোঁয়া বয়ে যায়। এবছর দূর্গাপ্রতিমা ৭টি তৈরির কাজ পেয়েছেন। ১৩ হাজার টাকা হতে ১৭ হাজার টাকায় প্রতিটি প্রতিমা তৈরি মূল্যেও চুক্তি হয়েছে। পোসাক পরিচ্ছেদ সহ মূর্তি তৈরির চুক্তি নিয়েছে। সব ব্যয় নির্বাহ করার পর কোন অতিরিক্ত লাভ থাকবে না বলে জানান। তবুও বানিয়ে দিয়েছেন পুজার জন্য। ধর্মের জন্য।
লালমনিরহাট জেলা দূর্গা প্রতিমা নির্মাণ শিল্পী সমিতির সভাপতি শ্রী মতিলাল বর্মন লালচান (৫৪) জানান, ২০ বছর ধরে তার স্ত্রী নারী প্রতিমা নির্মাণ শিল্পী হিসেবে কাজ কওে আসেছে। তার স্ত্রী রায় বংশের মেয়ে। তারা কখনো মাটির প্রতিমা তৈরির কাজ করেনি। আমার সংসারে এসে একট সহায়তা করতে করতে মন বশে যায় প্রতিমা তৈরির কাজে। এখন সে পাকা একজন প্রতিমা নির্মাণ শিল্পি। বৃহত্তর রংপুর বিভাগে একমাত্র নারী হিসেবে প্রতিমা তৈরি কাজ সে একাই করছে। মৃৎ শিল্পী নারী অনেক রয়েছে কিন্তু প্রতিমা তৈরির কাজ তিনি একাই করছেন। যারা কাদামাটি নিয়ে তৈজসপত্র তৈরি করে তাদের মৃৎ শিল্পী বলে। তারা স্বামী – স্ত্রী শুধুমাত্র কাদামাটির প্রতিমা ও বিভিন্ন দেব দেবীর বিগ্রহ তৈরি কওে থাকেন। এাঁ তার বাপদাদার পেশ। তার স্ত্রী কল্পনা রানী বর্মন সম্পর্কে বলেন, কখন যে একজন দক্ষ প্রতিমা শিল্পী তার স্ত্রী হয়ে গেছে বৃঝতেই পারিনি। তার হাতের ছোঁয়ায় প্রতিমা গুলো অনেক আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। ভক্তরা তার হাতের তৈরি প্রতিমা কিনতে বেশি আগ্রহী। এই পেশায় যেটি প্রয়োজন সুন্দর পবিত্র মন ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা।
জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার ভেলাগুড়ি ইউনিয়নের পূর্ব কদমা কালীরস্থান নামক মন্দিরের পাশে ব্র্যাক্ষণ সম্প্রদায়ের প্রতিমা তৈরির দুইটি পরিবার বসবাস করছে। গ্রামটিতে কয়েক শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবার রয়েছে। দুই মিনিট দুরত্বের পথে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। তার পাশে ভারতের কুচবিহার। পরিবার গুলো ১৯৪৭ সালে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে খুব সহজে ভারতে চলে যেত পারতেন। তারা যায়নি। কারণ এই দেশ তাদেও বাপদাদার দেশ। অসম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। তারা এখানে হিন্দু মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা কওে বসবাস কওে আসছে। ধর্মীয় আচার আচরণ পালনে কোন সমস্যা নেই।
প্রতিমা নির্মাণ শিল্পী কল্পনা রানী বর্মন আরো জানান, কৃষক পরিবারের মেয়ে তিনি। বিবাহ সূত্রে মালি পরিবারে স্বামীর সাথে বসবাস। দুই পুত্র সন্তান নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে প্রতিমা তৈরির কাজে তেমন কোন উৎসাহ নেই। ঢাকায় গিয়ে গামেন্টের্সে কাজ করে। ছোট ছেলে টুকটাক প্রতিমা তৈরির কাজ কওে আবার কৃষি শ্রমের কাজ করে। কাদামাটির কাজে অনেক পরি¤্রম ও ধৈর্যেও দরকার। সেই তুলনায় তেমন আয় নেই। প্রতিমা তৈরির অর্ডাও পেলে সংসার চলে না পেলে নেই। তাই এখন এই পেশায় কেউ আসতে চায় না।
প্রতিমা তৈরি করে কোন রকম বেঁচে থাকা খুবেই কষ্টে হয়ে গেছে। তিনি বলেন, মৃৎ শিল্পী বা শ্রম জীবি সাধারণ মানুষকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকারীণ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। মালি পরিবার বা প্রতিমা শিল্পী পরিবার হিসেবে তিনি বা তার পরিবার কোন খাদ্য সহায়তা পায়নি। সংসাওে একটু সচ্ছলতা পেতে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চেয়েছেন। দরিদ্র পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী পাঁকা ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। রেশনকার্ড, ১০ টাকা মূল্যের কার্ড কতকিছু সহায়তা দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি ও তার পরিবার কোন সহায়তা পায়নি। সচ্ছল জীবন পেতে একটু মাথাগোজার ঠাঁই পেতে তার স্বামীর ভিটায় পাকা বাড়ি সরকারি ভাবে নির্মাণ করে দিতে দাবি জানান। বাড়ির পাশের কালীমন্দির আশ্রমটিতে আর্থিক সহায়তা চান। তিনি তার এই প্রতিাম নির্মাণ শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি ও শ্রমের মর্যাদা চায়। তা না হলে এই পেশা তার পরের প্রজন্ম আর গ্রহন করবে না। প্রতিমা তৈরির জন্য চড়া দামে বিদেশ হতে প্রতিমা শিল্পীদের অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
দৈনিক দেশতথ্য//এল//

Discussion about this post