“বেশিরভাগ স্মৃতিই বেদনাদায়ক” কথাটির সাথে বহু আগেই পরিচিত। মানুষের জীবনে সুখ স্মৃতির চেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতিই বেশি। তারপরও এমন কিছু স্মৃতি আছে যা কষ্টদায়ক হলেও চিরস্মরণীয়। আমার শ্বশুরের প্রয়াণ দিবস সেই রকমই একটি দিন।
ব্যথাতুর এই দিনটি আমি ভুলতে পারি না। তাঁর অসুস্থতা শুরুর দিনটা ছিল বড়ই বেদনাবিধূর। সেদিন রাতে কর্মস্থল ইত্তেফাক থেকে কেবল বাসায় ফিরেছি। এমন সময় কিছু লোক ঠিকানা খুঁজে বাসায় এলো। তারা জানালেন, আমার শ্বশুর বাসায় ফেরার সময় মাথাঘুরে রাস্তাতেই পড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে জ্ঞান হারাবার আগে একজন পথচারীকে আমার নাম ও ঠিকানা বলতে পেরেছিলেন। ওই পথচারীরা তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান এবং আমাকে খুঁজে বের করে খবর দেন। সেই রাতেই ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।
এরপর তাঁর শেষ নি:শ্বাসের মূহুর্তেও পাশেই ছিলাম। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী, অমায়িক, আত্মীয় বৎসল মিতভাষী। তাঁর ছিল সীমাহীন ধৈর্য। তাঁকে কখনোই রাগান্বিত হতে দেখিনি। এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে অনেক প্রতিকুলতার মধ্যেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এর সুফল তাঁর সমস্ত অসচ্ছল আত্মীয়-স্বজন পেয়েছেন। তাঁর আর্থিক সহায়তায় অনেক আত্মীয়-স্বজন অশেষ উপকৃত হয়েছেন।
তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রিয় মানুষ ছিলেন। মনে পড়ে, উনি সব কাজ শেষ করে প্রায়ই রাত ১২ টায় বাসায় ফিরতেন। আমি অফিস থেকে ফিরতাম রাত একটায়। গভীর রাত অবদি তাঁর ঘর থেকে রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসতো। সময় দিতে না পারলেও সাহিত্য-কাব্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। আমার প্রিয় কণ্ঠা তিথি ছিল তাঁর নয়ন মনি। তিনি প্রতিদিন তিথিকে নিয়ে কিছুটা সময় কাটাতেন। তিথিকে নিয়ে অনেক কবিতা ও ছড়া লিখেছেন।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার টিকাটুলির ১৭ নম্বর অভয়দাস লেনে তাঁর তিনতলা বাড়ি ছিল। সে সময়ে ওই বাড়িটি ছিল মফস্বল শহর ও গ্রাম থেকে আসা কাছের ও দূরের সব আত্মীয় স্বজনদের তীর্থ স্থান। আত্মীয়-স্বজন আসছে যাচ্ছে থাকছে খাচ্ছে। তাদের আপ্যায়নের জন্য শ্বাশুড়ী সকাল থেকেই রান্নাঘরে অবস্থান নিতেন। এতে তাদের মধ্যে বিরক্তি বা ক্লান্তির কোন ছাপই কেউ কোনদিন দেখেননি। তাঁরা মানুষ খাইয়েই যেন বেশি আনন্দ পেতেন।
বিধাতার অমোঘ নিয়মে দিন চলে যায়। মানুষও চলে যায়। থেকে যায় শুধু স্মৃতি। গত ১লা জুলাই ছিল সেই স্মৃতি কাতরতার একটি বিশেষ দিন। প্রতি দিনই হয়তো তিনি নানা ভাবে আমার মণিকোঠায় হাজির হন। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটি যেন তাঁর গোটা সত্বা ও বহুমাত্রিকতা নিয়ে হাজির হয় আমার মানস পটে। মহান করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, তাঁকে বেহেস্তের বাসিন্দা করে রাখুন।
(দৈনিক দেশতথ্যের পাতায় রয়েছে স্মৃতিচারণ নামে একটি পাতা। এই পাতায় থাকে স্মৃতি স্মরণের বিশেষ আয়োজন। যে কোন পাঠক দৈনিক দেশতথ্যের ইমেইলে এমন লেখা পাঠালে তা প্রকাশ করা হয়। এই লেখাটি প্রবীণ সাংবাদিক খোন্দকার মুহাম্মদ খালেদের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত।)

Discussion about this post