কুষ্টিয়ার সুস্বাদু তিলের খাজা ও শনপাপড়ির খ্যাতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে । জেলার সীমানা ছাড়িয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে কুষ্টিয়ার তিলের খাজা ও শনপাপড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হচ্ছে । চিনি, তিল, আটা, বেসন, এলাচ, কিচমিচ, বাদাম, ডালডা, ঘি ও দুধ দিয়ে তৈরি করা হয় এই শনপাপড়ি ও তিলের খাজা। প্রাই ৪ যুগ ধরে কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়া ও কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়ায় বেশ কয়েকটি কারখানায় সব মৌসুমে এ খাজা ও শনপাপড়ি তৈরি হয়ে আসছে। হাতে তৈরি এই খাবারগুলো রাতে তৈরি হয়ে পরের দিন সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকাতে বিক্রি হয়। এ ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী পাইকারি দরে কিনে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে থাকে। অপরদিকে ঢাকার সাভার এলাকায় কুষ্টিয়ার কারিগর দিয়ে কয়েকটি কারখানায় এ শনপাপড়ি ও তিলের খাজা তৈরি করে কুষ্টিয়ার নামেই এগুলো বিক্রি হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।
শনপাপড়ি এক প্রকার হালকা মিষ্টিজাতীয় খাদ্যদ্রব্য। দেখতে বাদামী বর্ণ এবং ওজনে হালকা, সুতার মতো মিহি। বিশেষ প্রক্রিয়ায় আটা, ডিম, দুধ, চিনি ও ঘিয়ের সংমিশ্রণে চুলের যত মিহি ও সরু করে শনপাপড়ি তৈরি করা হয়। কোনো স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তিলের খাজা ও শনপাপড়ি তৈরি হয় না। তৈরি হয় ভীষণ দক্ষ হাতে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়ার মন্ডলপাড়ার আব্দুল কুদ্দুসের চুমকি নামক শনপাপড়ি কারখায় রাতে গিয়ে সরজমিনে দেখা গেছে, কাঠের লাকড়ি দেয়া চুলায় প্রকান্ড এক কড়াই বসিয়ে এক কারিগর তাতে ডালডা দিলেন। চুলার তাপে ডালডা গলে গেলে তাতে দেয়া হলো আটা। এবার আরেক কারিগর খুন্তি দিয়ে অনবরত ডালডা আটার মিশ্রণ নাড়তে থাকেন। একজন আটা ঢেলে যাচ্ছেন, আরেকজন খুন্তি দিয়ে নেড়ে যাচ্ছেন।
অপরদিকে চিনি আর পানি নিয়ে একজন কারিগর কড়াই ভর্তি চিনিতে সামান্য পানি দিয়ে চুলায় চড়িয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । এটাও কারখানার ঘরে চুলাতেই করা হয়ে থাকে।
সেখান থেকে বেড় হয়ে একটু এগিয়ে যেতেই অপর একটি কারখানায় গিয়ে দেখা গেল প্রাই ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক একই নিয়মে চিনি ও তিল দিয়ে তিলের খাজা তৈরি করে চলেছে। কারখানা মালিক জানালেন, দিনের বেলাই কারখানা বন্ধ থাকে। সন্ধার পর থেকে গভীর রাত পযন্ত আমাদের কারখানায় তিলের খাজা তৈরী করা হয়। তিনি আরও জানালেন, এ এলাকার তিলের খাজা ও শনপাপড়ি বিখ্যাত। বর্তমান এখানকার তৈরি তিলের খাজা ও শনপাপড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হচ্ছে।
ওই এলাকার আবির নামের শনপাপড়ি কারখানার প্রোপাইটর মাসুদ রানা ও চুমকি নামের শনপাপড়ি কারখানার প্রোপাইটর আব্দুল কুদ্দুস জানায়, শনপাপড়ি ও তিলের খাজা তৈরী করতে যে উপাদান গুলো প্রয়োজন হয়। তার প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। যার কারনে এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সরকারি ভাবে কোন সহযোগিতা পেলে অনেক পরিবার দুবেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। সেই সাথে বেঁচে থাকবে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্য বিখ্যাত তিলের খাজা ও শনপাপড়ির কারখানাগুলো।
উল্লেখ্য, এই কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া লালন শাহের জীবনকর্ম, জাতহীন মানব দর্শন, মরমি সঙ্গীত ও চিন্তা-চেতনার কারণে ছেউড়িয়ার সুনাম বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। সাংস্কৃতিক মহলে এটি লালনভূমি নামেও পরিচিত।
এই গ্রামটি মূলত সারা দেশে লালন মেলার কারণে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রতিবছর লালনের জন্মদিনে ও মৃত্যুবার্ষিকে এখানে ঘটা করে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে লালন একাডেমি। গ্রামটি কুষ্টিয়া শহরের পাশেই অবস্থিত । ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট লালন শাহের মাজার রয়েছে, এইজন্য ছেঁউড়িয়া দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিবছর এইস্থানে লালন মেলা বসে। কালীগঙ্গা নদীর তীরে লালন শাহের আখড়া বাড়ি লালন মাজার। প্রতিবছর এই গ্রামে পালিত হয় লালন স্মরণোৎসব। নির্ধারিত দিনক্ষণে সাধক লালনের আধ্যাত্মিক দর্শনলাভের আশায় দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য বাউল, সাধু, ফকির, লালনভক্তসহ হাজার-হাজার দর্শনার্থীর ঢল নামে। একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে এই ছেঁউড়িয়া।

Discussion about this post