সুদীপ্ত শাহীন, লালমনিরহাটঃ
শুস্ক মৌসুম তিস্তা নদীর পানি শূন্য। জেগে ওঠেছে প্রান্তরজুড়ে বালুচর ও দ্বীপ চর। সেই বালু চরে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষ হচ্ছে প্রায় সকল ধরনের ফসল। কৃষক তার উদ্ভাবনী চিন্তা ও মেধা-মনন দিয়ে বালুর মাঠ কে বানিয়ে ফেলেছে সবুজ ফসলের মাঠ। পিয়াজ, গম, কাউন, আলু, ভুট্টা, তামাক, নীল ও সবজিসহ নানা সফল ফলাচ্ছেন তিস্তা পাড়ের সংগ্রামী কৃষকরা। যে দিকে চোখ যায় শুধু ফসলের সবুজ মাঠ।
তিস্তার চরে এখন সকল ধরনের ফসল চাষ হয়। ফলনও হয় বাম্পার। এখানে কৃষক প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে চাষাবাদ করে না। তারা লাগসই প্রযুক্তি নির্ভর চাষাবাদ করে থাকে। এখন শুস্ক মৌসুম তবুও তিস্তার চরের কৃষকদের হড়কাবানের আশঙ্কা থাকে উজানি ঢলের কারণে। গত বছর শতকোটি টাকার উঠতি পিয়াজ ও বাদাম ভারতের উজানী ঢলে তলিয়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় কৃষক এই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। কৃষক পরিবার গেলো বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায় এবছর। নতুন বছরে নতুন ফসলের মাঠে স্বপ্ন বুননে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তিস্তা চরাঞ্চলের কৃষক ।
তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজান, রত্নাই, মালদা, সতী নদী বেষ্টিত লালমনিরহাট জেলা। তবে প্রধান দুইটি নদী তিস্তা ও ধরলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলে গেছে। এখন সকল নদী প্রায় পানি শূন্য। মরা গাঙ্গে পরিণত হয়েছে। নদীতে প্রায় শতাধিক চরাঞ্চল জেগেছে। এর মধ্যে তিস্তায় রয়েছে ৫৩ টি চর। এসব বালু চরে কৃষক পরিবার চাষাবাদ করে সবুজ ফসলের মাঠের সমারোহ সৃষ্টি করেছে। একনজর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রথম দর্শনে মনে হবে মরুর বুকে মরুদ্দান । কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষক পরিবারের সকল সদস্য মিলে একযোগে কৃষি কাজে মাঠে নেমে পড়ে । পুরুষদের সঙ্গে পরিবারের নারী, কিশোর কিশোরী এমন কী শিশুরাও নেমে পড়েছে। বিশেষ করে তামাক খেতে ভোর সকালে গৃহস্থলী কাজের পাশাপাশি পানি সেচ দিতে দেখা যায়। চরাঞ্চলের বালুময় জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলাতে হয়। নিতে হয় বাড়তি যত্ন। এখানে যত্ন করলে তবেই ফসলের মাঠে রত্ন মিলবে। চরের মানুষের এক মাত্র আয়ের উৎস কৃষি৷ বর্ষায় নৌকা চালানো ও মৎস্য শিকার। শীত মৌসুমে চরে ফসলের পাশাপাশি গবাদি পশু পালনে কৃষক আর্থিক লাভবান হয়।
পেলো বছর মানবসৃষ্ট হড়কাবানের কবলে পড়ে ফসলে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এক টি টাকাও ঘরে তুলতে পারেনি। এবার তাই ধার দেনা করে চরের কৃষক বালু জমিতে প্রচুর সেচ দিয়ে আলু, ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টি কুমড়া, তরমুজ, তামাক, মরিচ, রসুন ও পেঁয়াজ, কাউন, ফুলকপি, বাধাকপি, গাঁজর, সরিষা, নীল, আদা, গম, চিয়া, মিষ্টি আলু সহ নানান জাতের সবজি চাষাবাদ হয়েছে। এ বছর ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাষাবাদে খরচ বেশী পড়েছে।
এভাবেই প্রতিবছর কঠোর শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে ফসলের মাঠে স্বপ্ন বুনেন চরাঞ্চলের চাষিরা। শুষ্ক মৌসুমের চাষাবাদে অর্জিত আয়ের অর্থে বন্যাকালীন সহ বাকী সময় সংসার চলে চরবাসীর।
জেলার আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ সরওয়ার আলম জানান, গত বছর শীত মৌসুমের শেষ দিকে যখন পিঁয়াজ, রসুন, মাদাম, আলু, সহ নানা ধরনের ফসল তুলবে ঠিক সেই সময় গভীর রাতে চরবাসী ঘুমন্ত অবস্থায় ভারত সরকার গজল ডোবার সেচ প্রকল্পের পানি তিস্তা নদীতে ছেড়ে দেয়। এতে করে দেশের বৃহত্তর তিস্তা সেচ প্রকল্প রক্ষায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের ৪৪ টি গেট খুলে দিয়ে পানি প্রত্যাহার করতে হয়। দেখা দেয় বন্যা। আকর্ষিক এই হড়কাবানে এক হাজার কোটি টাকার ফসল ক্ষতি হয়েছে। সরকারিভাবে সেই ক্ষতির কথা স্বীকার করেছে। ক্ষতি হয়েছে চরের লোকালয়ের ব্রিজ কালভাট, রাস্তা ঘাট।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মিজানুর রহমান জানান, যৌথ নদী কমিশনের চুক্তি মেয়াদ ভারতের সাথে ছিল ২৫ বছরের। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে করে ছিলেন। তারপর আর চুক্তি নবায়ন হয়নি। ফলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ ও প্রত্যাহার সম্পর্কে শীত মৌসুমে ভারত বাংলাদেশ কে জানাতে বাধ্য নয়। তবে বর্ষা মৌসুমে ভারত বাংলাদেশ কে টাইম টু টাইম নদ, নদী নিয়ে সর্তকীকরণ বার্তা জানায়। গতবছর তিস্তা নদীর হড়কাবান সম্পর্কে কোন আগাম সর্তকতা ছিল না। তাই ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণে বেড়ে গেছিল। এবার আমরা সর্তক আছি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না ইনশাল্লাহ। যৌথ নদী কমিশন জিআরসি আলোচনা করছে পুনরায় বাংলাদেশ – ভারতের যৌথ নদী কমিশনের চুক্তি করার।
তিস্তা চরের কৃষক রোস্তম জানান, চরা আর কাইমের কৃষিতে অনেক পার্থক্য আছে। চরে খরচ বেশি ও পরিশ্রম বেশি হয়। সরকার চরের কৃষি নিয়ে পৃথকভাবে পরিকল্পনা করলে কৃষি ও কৃষক উপকৃত হবে। চরের কৃষিতে পৃথক ভর্তুকি চায়। চরে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা গণ যায়না। মাঠ পর্যায়ে কৃষি বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে চরের কৃষকের রয়েছে নানান খারাপ অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এর হিসাব মতে ভুট্টা সহ ফসলের ওপর কয়েক হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয় তিস্তা চরে প্রতিবছর। তিস্তা চরে ফসলের ওপর দেয়া ঋণের রিকভারি রেট অনেক ভাল শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ হামিদুল হক জানান, শীত মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় চরে আবাদ হয়। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা গণ কাজ করছে। এ বছর তামাক, ভুট্টা ও পেয়াজ চাষ আবাদ ব্যাপক হয়েছে। কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখে না পড়লে কয়েক শত কোটি টাকার ফসল চরের কৃষক ঘরে তুলতে পারবে। তিনি বলেন উত্তরাঞ্চলের মরু পক্রিয়া ঠেকাতে তিস্তা নদীর পানি চুক্তি খুব জরুরি। উত্তরের ভূ গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে আসছে। চওে অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। তা না হলে নদীর তলদেমের গঠন ধ্বংস হয়ে বিপর্যয় নেমে আসবে।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post